১. সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম

আর, ভালোবাসা যদি নিবেদন হয়? যদি হয় নিমন্ত্রণ, বিশুদ্ধ আহ্বান? যদি আরাধ্যটি হন স্বয়ং কৃষ্ণ, আর অপরজন এক পদকর্তা—তাও মুসলমান? 

এইসব ভণিতার দরকার ছিল না। দরকার হল গানটির জন্য। আমাদের বাংলাভাষায় কত যে মণিরত্ন ছড়িয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই গান, থুড়ি পদ তার অন্যতম উদাহরণ। রচয়িতা সৈয়দ মর্তুজা। খুব সম্ভবত চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। সময় আনুমানিক অষ্টাদশ শতক। এই পদে বিনোদ ওরফে কৃষ্ণকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করছেন সৈয়দ। কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তুই-তোকারির, কখনো আবার তুমি-র। ভক্তি বা ভালোবাসায় বাহ্যজ্ঞান লোপ পেলে যেমন হয় আর কী!

কী লিখছেন তিনি? 'বিনোদ আমার বাড়িত আয়/আমার বাড়িত আইলে বিনোদ জাতি নাহি যায়।' কবি সচেতন, যে, তিনি মুসলিম। কিন্তু তার থেকেও বড়ো পরিচয়, তিনি ভক্ত। তাই ভালোবেসে বলতে পারেন, আমার বাড়িতে এলে তোমার জাত যাবে না বাপু! এসোই না একবার! 

কৃষ্ণের 'বিনোদ' নামটি শুনলেই মনে পড়ে ভারতচন্দ্রের সেই বিখ্যাত পঙক্তি— 'ওহে বিনোদ রায় ধীরে ধীরে যাও হে/অধরে মধুর হাসি বাঁশিটি বাজাও হে।' ভারতচন্দ্রের ওই লাইনগুলির মধুর বিকল্প আজও কি জন্ম নিয়েছে বাংলাভাষায়! যাক সে-কথা। সৈয়দ মর্তুজা এরপর তুলে ধরেছেন বাংলার আবহমান গার্হস্থ্যচিত্রটি। বিনোদ হে, যদি বাড়িতে আসো, আপ্যায়নের অভাব হবে না। মুসলিমের হাতের রান্না খাবে না? বেশ, স্বপাকই খেয়ো না-হয়! ‘বিনোদ করিও রাঁধন’। তাতে সমস্যা নেই। হাঁড়ি-বাসন সবেরই জোগান দেব তোমায়। শুধু তাই নয়, বাড়িতে ফলানো বেগুন, খেতের সরু ধানের চাল— অভাব নেই কিছুরই। ভাতে-বেগুনে ফুটিয়ে দিব্যি পেটটি ভরবে।

এতেই থামছেন না সৈয়দ। প্রলোভন রয়েছে আরও। শালিয়া ধানের চাল, বিসমিলা ধানের খই, এমনকী মিষ্টি দইয়ের হাঁড়িও পাবেন বিনোদ, যদি একবার এসে হাজিরটুকু হন। শালিয়া ধান হল আজকের শালিধান— যার ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছেন সৈয়দ, ‘সরু ধানের চাল’ কথাটির মধ্যে। বিসমিলা ধান মোটা দানার, খই বানানো যায় দিব্যি। শালিধানের চালে ভাত আর বেগুন(পোড়া, না ভাজা?), সঙ্গে খই-দই— কী হে কেষ্টঠাকুর, মন্দ লাগছে এই ভোজনতালিকা?

মর্তুজার বাসায় বিনোদ এসেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে এমন নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে শক্তই। কত নতুন ধরনের ধানের নাম পেলাম বলুন তো! আপ্যায়নের পর, খাবার হিসেবে পেলাম বেগুন, ভাত, খই, দই। সেকালের বাংলার সংসার ও খাদ্যতালিকার একাংশ কেমন সুন্দর ফুটে উঠল, ভক্তিমার্গে যেতে যেতে।

সৈয়দ নিমন্ত্রণ করছেন, কেন-না 'মন ঝুরে তন পোড়ে ওই কালার লাগিয়া।' পাঠক, প্রচ্ছন্নমনে কি ভেসে উঠল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর— ‘তন ডোলে মেরা মন ডোলে...’? সৈয়দ বহুযুগ আগেকার মানুষ, এসব তাঁর জানার কথা নয়। তিনি কৃষ্ণবিরহেই আকুল। অথচ বাকিদের মতো হাপিত্যেশ করছেন না, বরং পাত পেড়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। এই পদে রাধা নেই, কিংবা সৈয়দ নিজেই রাধা। যত্নশীলা নারীটির মতো বিনোদকে পাত পেড়ে খাওয়াবেন। নাহ, নারীমন না-হলে এমন আদরআত্তি করবেই-বা কে! তাঁর মন উতলা, শরীরে জ্বালাভাব— এ কি শুধু নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর জন্য? কামেচ্ছা কি উঁকি দিচ্ছে না আড়ালে? ছিছি, প্রকাশ্যে সেসব বলতে নেই। বরং খেতেই আসুক বাড়িতে। সেটুকু কারণই সামনে থাক। তারপর যা হবে দেখা যাবে।

তবে, সংকোচও বড়ো কম নয়। ভিনধর্মের তিনি; বিনোদকে বলছেন, আমার ঘরে এলে তোমার জাত যাবে না। কিন্তু তাতেও কি আশ্বস্ত হতে পারছেন সৈয়দ? নইলে কেনই-বা স্বপাক ভোজনের প্রস্তাব দেবেন বিনোদকে!

এত কথা পেরিয়ে, পদটি এখন একবার সম্পূর্ণ না দেখলেই নয়—

‘বিনোদ আমার বাড়িত আয়
আমার বাড়িত আইলে বিনোদ জাতি নাহি যায়।।
হাড়ি দিমু বাসন দিমু বিনোদ বাড়ীর বেগুন
সরু ধানের চাউল দিমু বিনোদ করিও রাঁধন।।
শালিয়া ধানের চাউল দিমু বিসমালি ধানের খই
আমার বাড়িত আইলে দিমু মিষ্ট ভাণ্ড দই।।
সৈয়দ মর্তুজা কহে মনেতে ভাবিয়া
মন ঝুরে তন পোড়ে ঐ কালার লাগিয়া।।’

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে দুজন সৈয়দ মর্তুজার সন্ধান পাওয়া যায়। একজন মুর্শিদাবাদের, সপ্তদশ শতকের মানুষ। আমাদের আলোচ্য সৈয়দ মর্তুজার প্রচুর পদ উদ্ধার করা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে, ফলে মনে হয়, তিনি সে-অঞ্চলেরই বাসিন্দা ছিলেন। রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট সংখ্যক পদ রচনা করেছেন সৈয়দ, তবে, আলোচনা আবর্তিত হল একটি ব্যতক্রমী পদ নিয়েই। 

সৈয়দ মর্তুজাকে আমরা মনে রাখিনি প্রায় কেউই। অথচ আজকের এই সাম্প্রদায়িক গোলোযোগ বাঁধিয়ে দেওয়ার দিনে, এ-কথা বারবার বলা দরকার, এই বাংলায় একদিন সৈয়দ মর্তুজা ছিলেন। ছিলেন তাঁর মতো আরও অনেক মুসলমান গীতিকার, যাঁরা কৃষ্ণ-কালীকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য পদ। ভালোবেসেছেন তাঁদের। সেদিন বিপরীত ধর্মের কেউ বাধা দেয়নি, গোলও বাঁধায়নি। আমরা যেন সেসব ইতিহাস ভুলে না যাই...

অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor