কামাখ্যা মন্দির, মনসাপূজা ও দেওধানী নৃত্যশৈলী

ধর্মসংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা লক্ষ করেছেন—সভ্য শিক্ষিত সংস্কৃত জনগোষ্ঠী দেবতার আবাহন ও অবস্থানের আধার হিসাবে মানুষের নির্মিত বিবিধ শিল্পদ্রব্য বেশ পছন্দ করেন। যেমন ধরুন, ভারতীয় সংস্কৃতিতে পূর্ণঘট, মাটি-পাথর-দারু ইত্যাদি দিয়ে গড়ে তোলা প্রতিমা কিংবা নির্দিষ্ট ছাঁদে আঁকা যন্ত্র হয়ে ওঠে দেবচৈতন্যের আধার। কিন্তু, শুধুই কি তাই? প্রকৃতিতে যা কিছু প্রাকৃতিকভাবেই লব্ধ, সেইসবও কিন্তু হয়ে ওঠে পূজাধার, এবং অনেকক্ষেত্রে সেসব আধার মানুষের গড়া ঘট-মূর্তি-যন্ত্রাদির তুলনায় পবিত্রতর, পূজ্যতর। কারণ—প্রাকৃতিক আধারে দেবতার অবস্থান নিত্য, সেখানে আবাহন-বিসর্জন নেই। উদাহরণ? খুব চেনা তো— শালগ্রাম শিলা, বাণলিঙ্গ, গঙ্গা যমুনা আদি নদী, তুলসী অশ্বত্থ নবপত্রিকা আদি বৃক্ষলতা, কিংবা উদীয়মান সূর্য! 

এইবার, কামাখ্যামণ্ডলের দিকে যদি তাকান, দেখবেন সেখানেও প্রকৃতির বুকেই মানুষ খুঁজে পেয়েছে পূজাধার। পাহাড়ের বুকে ইতিউতি কঠিন শিলার ফাটল থেকে বেরিয়ে আসা জলস্রোত দেখে, সেখানেই সে অনুভব করেছে বিশ্বমাতার জীবন-ক্ষরা দেবীচৈতন্য, গড়ে তুলেছে বিভিন্ন মহাবিদ্যার দেবালয়। এদের মধ্যে প্রধানতম মন্দিরেরই অধিষ্ঠাত্রী জগন্মাতা কামাখ্যা—নামান্তরে যিনি কামেশ্বরী, জগতের সকল প্রাণবন্ত জীবচৈতন্যের আনন্দঘন সৃষ্টি-প্রবণতার ঘনীভূত মূর্তি। নীলাচল পর্বতে যখন শারদীয়া দুর্গোৎসব হয়, তখন সেখানে মানুষের গড়া মূর্তিপূজা মানা। দেবীর পূজার আধার সেখানে নবপত্রিকা—জীবন্ত উদ্ভিদ-গোষ্ঠী। স্বভাবতই, নানা পরিসরে এই প্রকৃতিমুখী উপাসনা-পদ্ধতি কামাখ্যামণ্ডলের মানুষজনের মজ্জাগত। আর তারই অন্যতম প্রকাশ দেওধানী উৎসব—যেখানে দেবচৈতন্য প্রকাশ পায় জীবন্ত মানুষের শরীরে। ভক্তের চোখে বিশেষ মুহূর্তে ঘটে যায় মানুষের দিব্যায়ন, মানবদেহ হয়ে ওঠে দেবসত্তার আধার৷ 

মনসামঙ্গলের কাহিনি-পরম্পরায় বলা হয়েছে, স্বর্গের নর্তক-দম্পতি ঊষা ও অনিরুদ্ধ অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে জন্ম নিয়েছিলেন বেহুলা ও লখিন্দর রূপে। দেওধানী শিল্পীদের বিশ্বাস, সেই স্বর্গীয় দেবলোকপ্রিয় নৃত্যশৈলীই এই দেবদম্পতির মর্ত্যরূপের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে মর্ত্যে। তাঁরা সেই নৃত্যপরম্পরার উত্তরাধিকারী। এই নৃত্য কেবল বিনোদনের জন্য নয়, এ নৃত্য দেবপূজার অঙ্গ। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজাপার্বণের অঙ্গ এই দেওধানী নৃত্য। লোকবিশ্বাস এই যে, নৃত্যের সময় নর্তকদের শরীরে আবিষ্ট হন তাঁদের আরাধ্য দেবতারা—কখনো শিব, কখনো গণেশ, কখনো কালী, আবার কখনো বা মনসা। দেওধানী নর্তকেরা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত—স্বর্গ দেওধানী এবং মর্ত্য দেওধানী। মর্ত্য দেওধানীরা বিভিন্ন অঞ্চলে নানা দেবতার পূজাপার্বণে নৃত্য করেন, কিন্তু স্বর্গ দেওধানীরা নির্দিষ্ট তীর্থভূমিতে, নির্দিষ্ট পার্বণেই কেবল নৃত্যের অধিকারী। শ্রাবণ-সংক্রান্তিতে কামাখ্যা মন্দিরে মনসাপূজা উপলক্ষ্যে এই স্বর্গ দেওধানীদের নৃত্যগীতের আসর বসে।

আরও পড়ুন
ঈশ্বর তোমাকে নৃত্যের জন্যই গড়েছেন

দেবী কামাখ্যার নাটমন্দিরে তিনদিন-ব্যাপী এই মনসা-পূজার আসর—প্রথমদিন অধিবাস, দ্বিতীয়দিন মূলপূজা, তৃতীয়দিন বিসর্জন। এই মন্দিরে নতুন দেববিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা নিষেধ হলেও মনসাপূজা সেখানে ব্যতিক্রমী। নাটমন্দিরের মনসা-বেদিতে অষ্টনাগ-মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে এই উৎসব আয়োজিত হয়। স্থানীয় মনসা-পূজকেরা আর্ষ সংস্কৃত মন্ত্র কিংবা পূজাবিধিতে অভ্যস্ত নন, স্থানীয় অহমিয়া ভাষার লোকায়ত মন্ত্রে (এর শাস্ত্রীয় নাম শাবর মন্ত্র) এবং উপজাতিদের নিজস্ব পদ্ধতিতে চলে মনসাপূজা। এই মন্ত্র ও পূজাবিধি মায়াং গ্রামের নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি। এখানে মনসা পূজার অন্যতম অঙ্গ সুকবি নারায়ণ দেবের মনসামঙ্গল পাঠ। নারায়ণ দেব এমন এক কবি—বাংলা ও অহমিয়া উভয় ভাষা-সংস্কৃতিতেই তিনি আপন, তাঁর কাব্য দুটি ভাষার সাহিত্য-ইতিহাসেই আলোচিত ও সমাদৃত। ভাষিক গণ্ডীর ঊর্ধ্বে ওঠার এমন নিদর্শন দুর্লভ বটে। 

আরও পড়ুন
নৃত্য সেদিন পেরিয়ে গেল মঞ্চের সীমা

এই নৃত্য কীভাবে আরম্ভ হয়? মনসাপূজার পরে, 'ওঝাপালি' (পূজারী) মন্ত্রপাঠ আরম্ভ করেন, এবং ক্রমে দেবতা আবিষ্ট হন নর্তকের শরীরে। দেবতার আবির্ভাবের সূচক হিসাবে দেহে দেখা দেয় কম্পন, কখনো-বা হুঙ্কার দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেন দেবতা। কখনো ধারালো কোনো অস্ত্র মুখে নেওয়া, কখনো জ্বলন্ত আগুন গিলে ফেলা—এরকম বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে নর্তক তাঁর শরীরে দেবতার আবির্ভাব প্রমাণিত করেন। উপস্থিত ভক্তরা এসময় জীবন্ত পায়রা, ছাগ ইত্যাদি বলি হিসাবে উৎসর্গ করেন দেবতাকে, আর নর্তক সেইসব প্রাণীকে সর্বসমক্ষে হত্যা করে রক্তপান করেন। সে দৃশ্য বড়ো উগ্র, কিন্তু তার মধ্যেই ভক্তরা দৈবী মহিমা খুঁজে পান। কখনও বা নর্তকের শরীর মৃতবৎ নিস্পন্দ হয়ে যায়, আবার সেই দশা থেকে তাঁর পুনরুত্থানও ঘটে। এই ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় মনসার লীলাবৃত্তান্ত—মৃত্যু ও পুনর্জীবন উভয়েরই নিয়ন্ত্রক তিনি। আবার, নৃত্যের শেষে ভক্তদের মধ্য থেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন এলে, তারও উত্তর আসে নর্তকের মুখ থেকে। কারণ, নর্তকের শরীরে তখন দেবতার আবাস, তাঁর জ্ঞান জনসাধারণের বুদ্ধির সীমার বাইরে। 

ভারতের বিভিন্ন ধ্রুপদী নৃত্যশৈলীই ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গীভূত নৃত্যের বিবর্তিত রূপ৷ বর্তমানে, পূজার অঙ্গন ছাড়াও মঞ্চে দেওধানী নৃত্যের উপস্থাপনা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। শিল্প হিসাবে এ নৃত্যশৈলীর ভবিষ্যত কী, তা সময়ই বলবে।

ছবিঋণ : উইকিমিডিয়া কমনস

Powered by Froala Editor