রবীন্দ্র-বিরোধিতার জের, বন্ধু দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন যতীন্দ্রমোহন বাগচীর

“বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?”

বাঙালির অত্যন্ত কাছের কবিতা ‘দিদি হারা’। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর (Jatindramohan Bagchi) সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় এই কবিতার সূত্রে। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ের কবিদের মধ্যে অন্যতম যতীন্দ্রমোহন আজ হয়তো অনেকটাই বিস্মৃত বাঙালির কাছে। রবীন্দ্রনাথের ধারার উত্তরসাধক হওয়ার দায়ভার বহন করা ছিল সত্যিই চূড়ান্ত পরীক্ষা। যতীন্দ্রমোহন সেই পরম্পরার পাশাপাশি নিজস্ব প্রতিভার ছাপ রেখেছিলেন প্রকৃতিচেতনায়। গ্রাম বাংলার স্নিগ্ধ-শীতল রূপ তিনি দেখেছেন দু’চোখ ভরে। কবিতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে পল্লীজীবনের ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখের সহৃদয় দিনযাপন।

১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর নদিয়ার জমশেরপুরের জমিদার বংশে তাঁর জন্ম। আজও বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কোনোরকমে টিকে রয়েছে তাঁদের পরিবারের বিরাট বাড়িটি। বহরমপুরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে যতীন্দ্রমোহন চলে আসেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করার সময় থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু এখানে। নামে জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও বিশ শতকের প্রথম থেকেই খর্ব হতে শুরু করেছে তাঁদের দাপট। আয়ও কমতে থাকে দ্রুতহারে। সদ্য বিবাহিত যতীন্দ্রমোহন কাজ খুঁজতে লাগলেন বিভিন্ন দপ্তরে। অবশেষে থিতু হলেন বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রের আপ্ত সহায়কের কাজে। শুধু আর্থিক নিরাপত্তা নয়, সারদাচরণের সান্নিধ্যে কবিজীবনেরও সূচনা হয় তাঁর।

সেই সময় নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রকাশ করেন ‘বিদ্যাপতি পদাবলী’। যার সম্পূর্ণ আর্থিক ব্যয়ভার বহন করেছিলেন সারদাচরণ। তাঁরই প্রতিনিধি হিসেবে বাংলার সাহিত্যিক মহলে পরিচিতি হয় যতীন্দ্রমোহনের। কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন কলেজে পড়াকালীন। এবার বহু মানুষের সূত্রে তা তীব্র গতি পায়। এই সময়েই সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লেখা’-র বেশ কয়েকটি কবিতা নিজে হাতে সংশোধন করে দেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৮ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয় ‘মানসী’ পত্রিকা। সুবোধচন্দ্র গুপ্ত মূল কর্ণধার হলেও সমস্ত দায়িত্বভার বহন করতেন যতীন্দ্রমোহন। 

আরও পড়ুন
‘বিদ্রোহী’ নজরুল, ‘আমি’-র মোহিতলাল মজুমদার এবং একটি কূট বিতর্কের গল্প

‘মানসী’ প্রথম দিকেই গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্র পরিমণ্ডলে। ফলে প্রায়ই রেশারেশি চলত ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সঙ্গে। যেখানে ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্রবিরোধিতা করতেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি-সহ আরো অনেকেই। পালটা উত্তর দিত ‘মানসী’ও। যতীন্দ্রমোহন অবশ্য শুরুতে নিজের নাম জড়াতে চাননি এই বিতর্কের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ রূপে মানলেও বন্ধুত্ব ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে। কিন্তু সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয় দ্বিজেন্দ্রলালের ‘কাব্যে নীতি’ প্রবন্ধের সূত্রে। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধটির বিরোধিতায় ওই নামেই একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন তিনি। কালিদাস রায় লিখছেন, “কবি যতীন্দ্রমোহন দ্বিজেন্দ্রলালের এই অবিচার ও অনাচার সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি দ্বিজেন্দ্রলালের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করিয়া তাঁহার প্রত্যেকটি ক্রূর মন্তব্য ও অযথা দোষারোপের উত্তর দেন। ইহার ফলে যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে বান্ধবতার বন্ধন চিরদিনের জন্য ছিন্ন হইয়া যায়।” তাতেও কি থামানো গেছিল এই বাকযুদ্ধ? এই ঘটনার বছর তিনেক পরে দ্বিজেন্দ্রলাল ফের রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করেন ‘আনন্দ বিদায়’ নাটকের মধ্যে দিয়ে।

আরও পড়ুন
মহাত্মা গান্ধী ও ‘জাতির জনক’ আখ্যা— একটি বিতর্ক

অবশ্য কবিতার জন্য তারপরেও যতীন্দ্রমোহন সম্মান দিয়ে এসেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালকে। মুক্তকণ্ঠে স্বীকারও করতেন সে-কথা। কিন্তু মানসী-সাহিত্য দ্বন্দ্বের পর তাঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, সে কথা কাউকে ঘুণাক্ষরে জানতে দেননি তিনি। বরং যতীন্দ্রমোহন লিখেছিলেন, “দ্বিজু-বাবু অতি অমায়িক, নিরহঙ্কার, উদার প্রকৃতির লোক ছিলেন। পরে, অন্যের প্রভাবে ও প্ররোচনায় তাঁহার সহিত আমাদের সদ্ভাবের যে অন্যথা হইয়াছিল, এবং যে কারণে হৃদ্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল, তাহা আর লিখিব না।”

ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর কবিতা, দুইই প্রবলভাবে আকর্ষণ করত যতীন্দ্রমোহনকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লেখা’ উৎসর্গ করেছিলেন ‘কবিগুরু’কে। পরবর্তীতে ‘রেখা’, ‘নীহারিকা’ ও ‘অপরাজিতা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থেও স্নেহস্পর্শ ছিল তাঁর। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ গান শেখাতে চেয়েছিলেন যতীন্দ্রমোহনের মেয়েকে। আসলে, তিনি যে সময় থেকে রবীন্দ্রভক্ত, তখনও সাহিত্যপ্রিয় বাঙালির মধ্যে দ্বিধা ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। নোবেল পুরস্কারের আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেতে তখনও এক যুগ বাকি। সেই কালেই তিনি কবিতায় আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাধনা।

সেটাই কি শেষ পর্যন্ত নাগপাশে বেঁধে ফেলল যতীন্দ্রমোহনের কবিতার নিজস্ব স্বরকে? বুদ্ধদেব বসুর ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ কিন্তু সে দিকেই ইঙ্গিত করে। তিনের দশক থেকে বাংলা কবিতার যে ধারাবাহিক পরিবর্তন আসছিল, সেখানে ক্রমেই ‘ব্রাত্য’ হয়ে পড়ছিলেন যতীন্দ্রমোহন। দুই কন্যা ও স্ত্রীকে হারিয়ে আরো একা হয়ে পড়েন। ১৯৪১-এ চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথও। নিজে কি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কালের ক্রমশ ফিকে হচ্ছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৪৪-এ একটি সভায় বলেছিলেন, “সত্যিই যদি ভালো লিখতে পারতাম। কালের কষ্টিপাথরে যদি সত্যকার সোনার দাগ রেখে যেতে পারতাম। কিন্তু মনের মধ্যে বুঝছি, সময় যে আমার হয়ে এসেছে।” তার বছর চারেকের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে যতীন্দ্রমোহনের। বাংলা কবিতায় আজ হয়তো কম চর্চিত তাঁর নাম, তবু সেদিনের বক্তৃতায় কিন্তু সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নতুন কবিতাকে। হারিয়ে যাওয়ার ভয় তাঁর ছিল না। বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদের আলো হয়েই বাংলা সাহিত্যে অমর থাকবেন যতীন্দ্রমোহন। 

Powered by Froala Editor