‘বিদ্রোহী’ নজরুল, ‘আমি’-র মোহিতলাল মজুমদার এবং একটি কূট বিতর্কের গল্প

দুজনে ছিলেন দুই মেরুর ব্যক্তি। বয়সের ব্যবধানও ছিল বছর দশেকের। তবু কীভাবে যেন মিলন হল দোঁহে। বেশি দিন নয়, বড়ো জোর বছর দেড়েকের বন্ধুত্ব। তারপর চিরবিচ্ছেদ। দুজনেরই কর্মক্ষেত্র কলকাতা, সাহিত্যচর্চা নিয়েই ঘরসংসার। কথা হচ্ছে মোহিতলাল মজুমদার (Mohitlal Majumdar) ও নজরুল ইসলামের (Nazrul Islam) মধ্যেকার বিতর্ক নিয়ে। ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। আর তারপরেই মোহিতলাল দাবি করলেন, এই কবিতার সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে তাঁর লেখা ‘আমি’ প্রবন্ধের। সেই নিয়ে সম্পর্কের মধ্যে এমন এক তিক্ততার জন্ম হল যে কথা বলা তো দূরের কথা, কবিতার মাধ্যমে উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্যে আক্রমণ চলতে লাগল নিয়মিত।

তার আগে একবার ফিরে দেখা যাক দুজনের সম্পর্কের রূপটিকে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মতে, নজরুলের ‘গুরু’ ছিলেন মোহিতলাল এবং তাঁকে নাকি ‘কুড়িয়ে পান’ গজেন ঘোষের বিখ্যাত আড্ডা। একশো বছর কেটে যাওয়ার পর এটুকু অন্তত স্পষ্ট যে, ‘কুড়িয়ে’ নেওয়ার মানুষ নজরুল নন। তিনি বিস্ফোরণের সামগ্রী। ফলে তাকাতে হয় অন্য সূত্রের দিকে। ১৯২০ সাল নাগাদ মোহিতলাল মজুমদারের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। যেখানে তিনি ‘কাজী সাহেব’-এর দুটি কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তারপরই প্রত্যক্ষ আলাপ দুজনে। মোহিতলাল তখন নেবুতলার হাইস্কুলের চাকরি ছেড়ে যুক্ত হয়েছেন মেট্রোপলিটন মেইন স্কুলে। আশেপাশের সবকটি কবিতার আড্ডা আর পত্রিকার অফিসে নিত্য যাতায়াত ছিল তাঁর। কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর আলোচনাও চলত এখানে।

ক্রমে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে নজরুলের সঙ্গে। সংস্কৃত ছন্দ, ইংরেজি কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তিনি যে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে মোহিতলালের ‘শিক্ষক’ সত্তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা ছিল ‘হাবিলদার’ নজরুলের পড়াশোনার পরিধি নিয়ে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তখন প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর পত্রোপন্যাস ও একাধিক কবিতা। জনপ্রিয়তাও পাচ্ছেন সেই সূত্রে। অবশেষে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে লিখলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। পরের বছরের জানুয়ারিতে ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৩৯ পংক্তির কবিতাটি প্রকাশিত হতেই সাড়া পড়ে গেল বাংলার পাঠকমহলে। পরে ছাপা হয় ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘প্রবাসী’-তে। স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা ছিল মোহিতলালেরও। কিন্তু তার বদলে তিনি নিয়ে এলেন অভিযোগ। ১৯১৫ সালে ‘মানসী’ পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘আমি’ প্রবন্ধ থেকে সরাসরি ভাববস্তু সংগ্রহ করেছেন নজরুল। এক ঘরোয়া আড্ডায় তিনি নজরুল শুনিয়েছিলেন প্রবন্ধটি, অথচ ‘বিদ্রোহী’-র ঋণস্বীকারে তাঁর নাম নেই। এমনকি বলে বসলেন, “নজরুল একটা চোর।” 

সত্যিই কি নজরুল অনুপ্রেরণা পেয়েছিল ‘আমি’ থেকে? দুটি সাহিত্যের রূপ পাশাপাশি রাখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে চিত্রটি। প্রথমে দেখা যাক বহুচর্চিত ‘বিদ্রোহী’-কে,

আরও পড়ুন
নজরুলের গানে অনাগত স্বাধীনতার চেতনা এবং ‘দেবী দুর্গা’ নাটক

“আমি   চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর।
আমি দুর্বার।”

আরও পড়ুন
কৃষ্ণের হোলি খেলা নিয়ে গান লিখলেন নজরুল, রেকর্ডে কণ্ঠ মহম্মদ রফির

এবার ‘আমি’ প্রবন্ধের পালা,

“আমি বিরাট। আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর, নভো-নিলীমার ন্যায় সর্বব্যাপী। চন্দ্র আমারই মৈলুশোভা, ছায়াপথ আমার ললাটিকা, অরুণিমা আমার দিগন্তসীমান্তের চন্দ্রচ্ছটা, সূর্য্য আমার তৃতীয় নয়ন এবং সন্ধ্যারাগ আমার ললাট-চন্দন।”

উদাহরণ আরো দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু সমগ্র প্রবন্ধটির মূলরূপ এরকমই। এবং এটাও বোঝা যায় যে ‘আমি’ শব্দটি ছাড়া নজরুলের কবিতা আর কোনোভাবেই ঋণী নয় তাঁর কাছে। বড়োজোর চোখে পড়তে পারে দুয়েকটি শব্দের মিল। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’র আইনভাঙা হিন্দোলের সঙ্গে ভাবগত কোনো মিলই নেই মোহিতলালের প্রবন্ধের।

তাহলে কেন এই অভিযোগ? মুজফফর আহমেদের মতে, “নজরুল ইসলাম যে তাঁর আওতা হতে, তাঁর শাসন হতে বেরিয়ে গেল তার জন্য তার উপরে খানিকটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন।” বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি ও সমালোচকের প্রসঙ্গে এই অভিযোগ যে যথেষ্ট গুরুতর সন্দেহ নেই। তবে, এখানেই বিতর্কের শেষ হয়নি। ১৯২৪-এ প্রকাশিত হয় ‘শনিবারের চিঠি’, যার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন নজরুল। তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে লেখা ছাপা হওয়া ছিল প্রতি সপ্তাহের কাজ। প্রথম সংখ্যাতেই ছাপা হয় ‘গাজি আব্বাস বিটকেল’ নামের একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা। তারপর বেনামে সজনীকান্ত দাস লিখলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার একটি প্যারোডি। নাম দিলেন ‘ব্যাঙ’,

“আমি সাপ, আমি ব্যাঙরে গিলিয়া খাই,
আমি বুক দিয়া হাঁটি ইঁদুর-ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।

‘শনিবারের চিঠি’-র লেখার ধরনই ছিল এরকম। রবীন্দ্রনাথও ছাড় পাননি এদের থেকে। যে কারণে ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এ লিখেছিলেন নজরুল, “প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন হাড়িচাঁচা।” মুশকিল হল এই ‘ব্যাঙ’-কে নিয়েই। সজনীকান্ত দাসও যেন অপেক্ষায় ছিলেন এই সুযোগের। পাঁচ সিকে দিয়ে মোহিতলালের ‘স্বপন পসারী’ কিনে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে ফেললেন তাঁর সঙ্গে। ‘শনিবার’-এর সঙ্গে হাত মেলালেন মোহিতলাল। ফলে অনেকেই ভাবলেন, ছদ্মনামে হয়তো তিনিই ‘ব্যাঙ’-এর সাহায্যে বিষ ঢালছেন নজরুলের বিরুদ্ধে।

কিছুদিন পরে ‘কল্লোল’-এ বেরোয় নজরুলের ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ কবিতা। যেখানে পরম শ্রদ্ধাসহ তিনি সাবধান করে দিলেন পুরনো সঙ্গীকে, 

“তুমি ভিড়িও না গো-ভাগাড়ে-পড়া চিল-শকুনের দলে,
শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে।”

ততদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। প্রত্যুত্তরে ‘দ্রোণ-গুরু’ কবিতায় লিখলেন অনেক কথা। সেখানে নজরুলের সম্ভাবনা, আক্ষেপ, অভিযোগ থেকে শুরু করে জাতিবিদ্বেষের সীমা পর্যন্ত লঙ্ঘন করে ফেললেন তিনি। এখানেও নজরুলকে ‘শিষ্য’-এর বেশি মর্যাদা দিলেন না কিছুতেই। তাঁর কবিতার নিজস্ব চলন যে মোহিতলালের ‘শিক্ষা’-কে অস্বীকার করেছে বারে বারে, তা যেন মেনে নিতে পারেননি কিছুতেই। ফলে চিরকালের মতো দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। বিরাট পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও ‘শনিবার’-এ সীমাবদ্ধ থেকে গেলেন মোহিতলাল, আর নজরুলের চির উন্নত শির উঠে দাঁড়াল বিশ্ব ছাড়িয়ে। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More