‘উৎসব’-এ সামিল মৃত ব্যক্তিরাও, নাচ-গানে পালিত হয় পুনর্মিলন

উৎসব মানেই ঘরে ফেরার ডাক। পরিবারের সকলে মিলে আনন্দে মেতে ওঠা। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়রা একত্রিত হয়ে কয়েকটা দিনের জন্য নতুন করে ছুঁয়ে দেখেন নিজের শিকড়কে। শুধু বাঙালি বলে নয়, বিশ্বের সব প্রান্তেই প্রচলিত এই প্রথা। কিন্তু যদি জীবিতদের সঙ্গে মৃতদের আগমন ঘটে সেই উৎসবে? আশ্চর্যজনক শুনতে হলেও, এমনই এক রেওয়াজ আছে আফ্রিকার মাদাগাস্কারে (Madagascar)। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মৃত পূর্বপুরুষদের দেহ কবর থেকে তুলে এনে পূর্ণ করা হয় পরিবারের বৃত্ত। যার নাম ‘ফামাদিহানা’ (Famadihana) উৎসব।

কবে থেকে এই উৎসবের সূচনা, তা বলা মুশকিল। মনে করা হয়, উনিশ শতকের শুরুতে যুদ্ধফেরত মৃত সৈনিকদের দেহ নতুন করে কবরস্থ করার মধ্যে দিয়ে পথ চলা শুরু হয় ফামাদিহানার। আসলে, এই উৎসব পুনর্মিলনের। পরিবারের নতুন সদস্যদের সঙ্গে পূর্বজদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। যাতে তাঁরা ঐতিহ্য থেকে, নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন না হয়। প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে পালন করা হয় ফামাদিহানা। এখানে কবর দেওয়ার রীতিও বেশ অদ্ভুত। সাধারণত তৈরি করা হয় দুটি বিরাট আকারের কবর। যার একটি পুরুষদের, অন্যটি মহিলাদের। গ্রামের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত বা জ্যোতিষী প্রতিটি পরিবারের জন্য ঠিক করে দেন দুটি নির্দিষ্ট দিন। প্রথম দিনকে বলা হয় ‘ফিদিরানা’, অর্থাৎ কবর খুলে মৃতদেহ বের করার দিন। দ্বিতীয় দিনটির নাম ‘ফামোনোসানা’, এই দিন যাবতীয় উৎসব পালনের পর পুনরায় কবরস্থ করা হয় আত্মীয়দের।

তবে প্রতিবারই যে সব পরিবারের পূর্বপুরুষদের কবর থেকে তোলা হয়, তা নয়। কিন্তু প্রস্তুতি চলতে থাকে সারা বছর ধরেই। তারিখ ঠিক করা, খরচের হিসেব, আমন্ত্রিতদের তালিকা তৈরি— কাজের পরিমাণ নিছক কম নয়। উৎসবের সময় কবর থেকে উত্তোলিত দেহটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয় সাদা কাপড়ে। সুগন্ধি মাখিয়ে করে তোলা হয় ‘পবিত্র’। তারপর সকলে মিলে শুরু হয় নাচ-গানের পর্ব। প্রত্যেকের চোখেমুখেই থাকে আনন্দের ঝলক। শোক নয়, চেনা কোনো মানুষের প্রত্যাবর্তনের মুহূর্ত উদযাপন চলে ফামাদিহানার মাধ্যমে। রাতে থাকে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা। নতুন সদস্যদের সঙ্গে আলাপ হয় পূর্বজদের। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি উঠে আসে পুরনো গল্প। যেন একটি পরিবারের পুনর্মিলনের উৎসব। দুই থেকে সাতদিনের মধ্যে কাপড়ে নাম লিখে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পুরনো কবরে। পরিবারের কর্তা সৌভাগ্যের চিহ্ন রূপে সযত্নে তুলে রাখেন সাদা কাপড়টি।

সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই কমে এসেছে এই রেওয়াজ। এত মানুষের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা যেমন ব্যয়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার, তেমনই মৃতদেহ নিয়ে উৎসবকে ঘিরে বিতর্কও দানা বেঁধেছে প্রায় সময়েই। বিশেষ করে খ্রিস্টান মিশনারিরা এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব ছিল দীর্ঘদিন। যদিও মাদাগাস্কারের স্থানীয় মানুষরা মনে করেন, এই উৎসবে ধর্মের থেকে বেশি জড়িয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। কিন্তু বর্তমানে কাজের সূত্রে অনেকেই পাড়ি দিচ্ছে গ্রামের বাইরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাদের সুযোগ হয় না উৎসবে অংশগ্রহণ করার। নতুন প্রজন্মও এ বিষয়ে কিছুটা উদাসীন। 

আরও পড়ুন
কপালে ছাই দিয়ে এঁকে দেওয়া হয় ক্রুশচিহ্ন, এই খ্রিস্টান উৎসবের তাৎপর্য কী?

কালের নিয়মে এই উদাসীনতা হয়তো অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু, ফামাদিহানার শিকড় লুকিয়ে এখানেই। প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে যেন প্রবাহিত হয়ে চলে পরিবারের মৌখিক ইতিহাস। ক্রমে ভেঙে পড়তে থাকা সামাজিক কাঠামোর মধ্যে চিরকালীন হয়ে থাকুক অতীতের স্মৃতি। মৃতদেহের সৌজন্যে জোড়া লেগে যায় কত পুরনো-ভাঙা সম্পর্ক। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের মানুষের মধ্যেই রয়েছে এই প্রবণতা। ধর্মভেদে হয়তো পার্থক্য হয় আচারের। কোথাও মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে, কোথাও বা মৃতব্যক্তির আত্মার জন্য উৎসবের আয়োজন করে। ফামাদিহানাও নিজস্ব রীতিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে তার অতীতকে, তার ইতিহাসকে। 

আরও পড়ুন
শিকার ছেড়ে সিন্থেটিক চামড়াতেই উৎসব, নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর

Powered by Froala Editor