হরিনামেই ছেড়েছে ভূত! আইআইটি-র অধ্যাপকের বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক

“আমার যা বলার বলেছি। ভূত আছে। হ্যাঁ, ভূত আছে।” একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন অধ্যাপক (IIT Professor) লক্ষ্মীধর বেহেরা (Lakshmidhar Behera)। প্রসঙ্গ, ৭ মাস আগে একটি ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচারিত তাঁর একটি ভিডিও। তাতে ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। কোনো এক বন্ধুর পরিবারে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়। এবং তিনি সেখানে পৌঁছে হরিনাম জপের সাহায্যে সেই ভূত বিতাড়িত করেছেন। কে এই লক্ষ্মীধর রেড্ডি? না, তিনি কোনো ধর্মীয় নেতা নন। আইআইটি মান্ডির নবনিযুক্ত আধিকারিক লক্ষ্মীধর বেহেরা। আর ঠিক এই কারণেই সেই ভিডিও নতুন করে ভাইরাল হয়ে উঠেছিল। আইআইটি-র আধিকারিক হিসাবে যোগ দেওয়ার একদিনের মাথায় বিতর্ক শুরু হয় সেই ভিডিওটিকে ঘিরে।

দীর্ঘদিন কানপুর আইআইটি-তে অধ্যাপনার পর ১৩ জানুয়ারি আইআইটি মান্ডির আধিকারিক হিসাবে নিযুক্ত হন অধ্যাপক বেহেরা। তাঁর বিষয় ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং রোবোটিক্স। দিল্লি আইআইটি-র প্রাক্তনী অধ্যাপক বেহেরা পরবর্তীকালে জার্মানির সেন্টার ফর ইনফরমেশন টেকনোলজি থেকে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণা করেছেন। ২০০১ সাল থেকে তিনি কানপুর আইআইটি-র সঙ্গে যুক্ত। বেহেরার এই বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে আইআইটি-র বক্তব্য, সংস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই জানেন যে অধ্যাপক বেহেরা একজন ধার্মিক মানুষ। তবে প্রশ্নটা শুধুই তাঁর ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে থেমে থাকে না। কারণ সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, আধুনিক বিজ্ঞান অনেককিছুই ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

বিজ্ঞান নানাকিছুর ব্যাখ্যাই দিতে পারেনি, এতে সন্দেহের জায়গা নেই। সেই কারণেই আজও বিজ্ঞানে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে। সমস্তকিছুর ব্যাখ্যা জানা হয়ে গেলে আর গবেষণার প্রয়োজন থাকত না। কিন্তু অধ্যাপক বেহেরা গবেষণার পথ না নিয়ে পথ খুঁজলেন নানা প্রচলিত অপবিজ্ঞানের মধ্যে। এই অপবিজ্ঞান কথাটিও অবশ্য সর্বজনস্বীকৃত নয়। কিন্তু এটুকু বলা যায়, ভূত দর্শনের যে রোমহর্ষক বর্ণনা অধ্যাপক বেহেরা দিয়েছেন তার সঙ্গে কোনো ধর্মবিশ্বাসের সম্পর্ক নেই। বরং তা একেবারেই পাশ্চাত্য ভৌতিক গল্প অনুপ্রাণিত এবং এইসমস্ত গল্পের জন্মও মধ্যযুগের আগে নয়। তাই অধ্যাপক বেহেরার বক্তব্য হতে পারে যে তিনি গীতার মধ্যেই এই আদিভৌতিক কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, কিন্তু সেই বক্তব্য অন্তত গীতা বা এমন কোনো শাস্ত্র মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

অবশ্য এই সবই নেহাৎ মামুলি কিছু বিতর্ক। এইসমস্ত বিতর্কের পরেও জ্যোতিষী বা ওঝাদের ব্যবসা চলবে রমরমিয়ে। আগেও চলেছে। কিন্তু যা আগে কোনোদিন হয়নি, তা হল বিজ্ঞানের চেনাজানা পরিসরের মধ্যে এভাবে অপবিজ্ঞান প্রবেশ করেনি। ভারতের গর্ব আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীরা; যাঁরা এইসমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। এবং সত্যি সত্যি দেশের ইতিহাস খুঁড়ে বের করতে চেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ইতিহাসকে। অধ্যাপক বেহেরার এই মন্তব্য সেই ধারাটির সামনে বিদ্রূপের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

আরও পড়ুন
ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরলে ৫ বছরের কারাবাস, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত মরিসন সরকারের

আর সেইসঙ্গে উঠে আসে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটও। কারণ দেশের সবচেয়ে বড়ো প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই আইআইটি-তেই সম্প্রতি শুরু হয়েছে রামায়ণ-মহাভারত চর্চা। রামায়ন মহাভারতের কাল্পনিক অস্ত্রশস্ত্রকে বাস্তব ইতিহাস বলে প্রচারও চলছে। এমনকি আইআইটি-তে জ্যোতিষ শিক্ষার দাবিও উঠছে। বিহারে সরকারিভাবে তৈরি হয়েছে ‘জ্যোতিষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র’। ওষুধ নয়, রোগ সারাতে সেখানে ব্যবহার করা হবে নানা গ্রহরত্ন। একদিকে আর্থিক সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ কমানোর কথা জানাচ্ছে ইউজিসি। আর অন্যদিকে সবার সামনে রমরমিয়ে চলছে কুসংস্কারের প্রচার। এই সময় আবারও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীদের উত্তরসূরিদের ভীষণভাবে প্রয়োজন। যাঁদের কাজ শুধুমাত্র গবেষণাগারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্রতও নেবেন তাঁরা। রাস্তায় নেমে ঠিককে ঠিক, ভুলকে ভুল বলাটা ভীষণভাবে প্রয়োজন।

আরও পড়ুন
বিতর্কিত সুপার লিগ থেকে পলায়ন ৯ ক্লাবের, অনড় বার্সা-রিয়াল-জুভে

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষাক্ত জল ফেলা হবে সমুদ্রে, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত জাপানে