সামান্য একটি মথের দৌলতেই ‘বাগ’-এর আবির্ভাব কম্পিউটার জগতে

সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে হামেশাই চোখে পড়ে একটি কথা। ‘বাগ’। সতর্ক করা হয়, এই বাগের কারণেই মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে হানা দিতে পারে হ্যাকাররা। নষ্ট হয়ে যেতে পারে ডিভাইসও। আক্ষরিক অর্থে ‘পোকা’-কে বোঝালেও, বৈদ্যুতিন জগতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর যে কোনো ভুলকেই বলা হয় বাগ (Bug)। কিন্তু প্রোগ্রামিং নয়, বরং এই বাগ কথাটির জন্ম হয়েছিল কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার বা যান্ত্রিক গোলযোগ থেকে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, আদতেই সেই যান্ত্রিক গণ্ডগোলের কেন্দ্রে ছিল নিছকই একটি পোকা। একটি মথ (Moth)।

শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। সেটা ১৯৪৭ সাল। কম্পিউটার প্রযুক্তির একদম প্রথম যুগ বলেই ধরে নেওয়া যায় সময়টাকে। সে-সময়ের ইলেকট্রোমেক্যানিকাল কম্পিউটারের যান্ত্রিক গঠন ছিল বেশ জটিল। আয়তন ছিল আস্ত একটা ঘরের মতো। ফলত, দীর্ঘ বৈদ্যুতিক তার দিয়ে সংযুক্ত করে রাখা হত তার যন্ত্রাংশগুলিকে। আর সেখানেই বিপত্তি বাধায় একটি মথ। 

অকুস্থল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই রয়েছে তৎকালীন সময়ের প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত মানের কম্পিউটার ‘মার্ক ২’। আর তার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন কম্পপিউটার প্রোগ্রামিং-এর অন্যতম পথিকৃৎ গ্রেস হপার। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ৯ সেপ্টেম্বর। হার্ভার্ডের ল্যাবরেটরিতে মার্ক ২-তেই তখন কর্মরত হপার। হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় কম্পিউটার। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ছড়িয়ে পড়ে শর্ট সার্কিটের পোড়া গন্ধ। ব্যাপার কী? সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় তল্লাশি। শেষমেশ আবিষ্কৃত হয়, কম্পিউটারের রিলে প্যানেলের ওপর এসে বসেছিল একটি মথ। বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে সেটির। আর সেই কারণেই শর্ট সার্কিট।

মিনিট কুড়ির চেষ্টায় শেষমেশ মার্ক ২-কে জীবিত করে তোলেন হপার। আর মথটিকে? সেটির মৃতদেহ সযত্নে নিজের ডায়েরিতে সেঁটে রাখেন টেপ দিয়ে। তলায় মজার ছলেই লিখে রাখেন, ‘ফার্স্ট অ্যাকচুয়াল কেস অফ বাগ বিইং ফাউন্ড’। 

আরও পড়ুন
জ্যান্ত বিড়াল দিয়ে তৈরি টেলিফোন! চমকে দিয়েছিলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী

আরও পড়ুন
কী আছে পৃথিবীর পেটের ভিতর? গর্ত খুঁড়লেন বিজ্ঞানীরা, তারপর...

হ্যাঁ, কম্পিউটারের জগতে সেটিই ছিল প্রথম ‘বাগ’ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় অন্য একটি জায়গায়। ‘ফার্স্ট অ্যাকচুয়াল কেস অফ বাগ’— থমকে যেতে হয় এই শব্দবন্ধটিতে এসে। তবে কি এর আগেও অস্তিত্ব ছিল ‘বাগ’-এর? 

আরও পড়ুন
মহাকাশে পাড়ি দেওয়া প্রথম বিড়াল ‘ফেলিসেট’, রয়ে গেল বিস্মৃতির অতলেই

ঠিক তাই। গ্রেস হপারেরও আগে ‘বাগ’ কথাটির প্রবর্তন করেছিলেন বৈদ্যুতিক বালবের স্রষ্টা থমাস আলভা এডিসন। তবে তার সঙ্গে কম্পিউটারের যোগ নেই কোনো। ১৮৭৩ সাল সেটা। এডিসন তখন কাজ করছেন টেলিগ্রাম প্রেরণের কোয়াড্রুপ্লেক্স সার্কিট নিয়ে। লক্ষ্য, একটি টেলিগ্রাম তারের মধ্যে দিয়ে একই সঙ্গে চারটি মর্স কোর্ড পাঠানো। তার মধ্যে দুটি যাবে একদিকে, অন্য দুটি যাবে বিপরীত দিকে। তবে বহু চেষ্টা করেও এই যন্ত্র বানাতে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন এডিসন। বিদ্যুতের দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মর্স কোডেড বার্তার পোলারিটিও পাল্টে যাচ্ছিল ক্রমশ। তৈরি হচ্ছিল ব্রেকেজ।

পতঙ্গদের গতিবিধি যেমন অনিশ্চিত, ঠিক তেমনই অনিশ্চিত ছিল কোয়াড্রুপ্লেক্স যন্ত্রের মর্স কোডের পোলারিটি পরিবর্তনও। সেই কথা ভেবেই ‘বাগ’ শব্দটি ব্যবহার করেন এডিসন। এমনকি পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন টেলিগ্রামের মর্স কোডের উপরিপাত বন্ধ করতে যে বিশেষ বন্দোবস্ত করেন এডিসন, তার নামও রেখেছিলেন ‘বাগ ট্র্যাপ’। 

তবে বাগ কথাটি কেবলমাত্র টেলিগ্রামের ক্ষেত্রেই সীমিত থাকেনি। বরং, পরবর্তীতে সমস্তরকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রের গোলযোগেই ব্যবহৃত হত এই শব্দবন্ধটি। তবে একদিন ‘বাগ’ যে সশরীরে এসে হাজির হবেন বিপত্তি বাঁধাতে— তা আর কে-ই বা জানত!

Powered by Froala Editor

More From Author See More