বর্তমান বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রনেতা, চিলির নতুন রাষ্ট্রপতির উত্থানকাহিনি

কয়েকদিন আগের কথা। রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে নেমে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। প্রয়োজনীয় ৩৫ হাজার রাজনৈতিক সদস্যের সই পেতেই কালঘাম ছুটেছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কোনোক্রমে সেই সীমানা অতিক্রম করেন তিনি। গ্যাব্রিয়েল বরিচ। গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে বর্তমানে জায়গা করে নিয়েছেন চিলির ৩৫ বছর বয়সী এই বামপন্থী ছাত্রনেতা। গত ২২ তারিখ চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন বরিচ (Gabriel Boric)। চিলির (Chile) কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপতি তো বটেই, বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রনেতাও এখন তিনিই।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদপ্রার্থী হতে পারবেন বরিচ, সে-কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কেউ। সেখানে দাঁড়িয়ে নির্বাচনজয় এক কথায় ঐতিহাসিকই বটে। ভোট গণনা শুরুর মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নেন বরিচের প্রতিদ্বন্দ্বী তথা অতি-দক্ষিণপন্থী নেতা অ্যান্তোনিও হোসে কাস্ত। শেষ পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নজির তৈরি করেছেন বরিচ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অপরিচিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এমন আকস্মিক উত্থানের কারণ কী? 

পিছিয়ে যেতে হবে বছর দুয়েক। সেটা ২০১৯ সাল। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক দাঙ্গা। আর তার কারণ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য। রেলের ভাড়া থেকে শুরু করে বেসরকারিকরণ, সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সাম্প্রদায়িকতা এবং অসমতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন গোটা দেশের মানুষ। এক কথায় অঘোষিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছিলেন চিলির নাগরিকরা। আর এই প্রতিবাদ ঘিরেই দাঙ্গার রূপ নেয় পরিস্থিতি। 

সেই প্রতিবাদ-আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন ছাত্রনেতা বরিচ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার পর প্রচারের সময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্য একবারও প্ররোচনা দেননি বরিচ। বরং, তাঁর মূল লড়াই ছিল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তৃতায় বার বার উঠে এসেছিল সাম্যের কথা, দেশের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো, দুর্নীতি দূরীকরণ এবং নতুন ভবিষ্যতের কথা। আর সেখানেই যেন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 

আরও পড়ুন
দেশ ছেড়েও পরিত্রাণ নেই, চিলিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ভেনেজুয়েলার শরণার্থীরা

ক্ষমতায় আসার পর গতকালই বোরিচ জানান, চিলির নব্যউদারপন্থী অর্থনীতির পরিকাঠামো ভাঙতে হবে সমাজে সাম্য ফেরাতে গেলে। আর সেই পথেই হাঁটবেন তিনি। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট তুলে এনে তিনি দেখান চিলির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পদই মাত্র ১ শতাংশ মানুষের করায়ত্তে রয়েছে। এই পরিসংখ্যানের বদল করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। 

আরও পড়ুন
বয়স ‘মাত্র’ ৬৯, দিব্যি মাঠ কাঁপাচ্ছেন চিলির মহিলা গোলরক্ষক

বরিচের এই সিংহগর্জনে টলমল আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। দীর্ঘদিন ধরেই চিলির দক্ষিণপন্থী সরকারকে পিছন থেকে সমর্থন করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ১৯৭৩ সালে ডানপন্থী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনেতা অগাস্টো পিনোচেটের উত্থানেও সরাসরি সমর্থন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছিল বামপন্থী রাষ্ট্রনেতা সালভাদোর অয়েন্দেকে। তারপর নির্বাসন, নির্যাতন এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন হাজার হাজার চিলির নাগরিক। 

আরও পড়ুন
বদলাচ্ছে সংবিধান, জনগণের প্রতিবাদে পিছু হটল চিলি সরকার

বরিচের রাষ্ট্রপতিত্ব যেন সেই অয়েন্দে সরকারেরই নবরূপ হতে চলেছে আগামীদিনে। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই চিলি তথা ল্যাটিন আমেরিকার এই বামপন্থী উত্থান চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে আমেরিকার কপালে। অন্যদিকে নব্য-পিনোচেটবাদী দক্ষিণপন্থীরাও ক্রমশ জটিল করে তুলছে চিলির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই অস্থিতির জটের মধ্যে থেকে বরিচ চিলিকে নতুন ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারেন কিনা, এখন সেটাই দেখার… 

Powered by Froala Editor