মৃত ব্যক্তির মাথা ‘সংগ্রহ’ করতেন এই ব্যক্তি

নিউজিল্যান্ডের (New Zealand) অন্যতম প্রাচীন জনজাতির নাম মাওরি (Maori)। বেশ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী মাওরিদের মূল জীবিকা ছিল সমুদ্রে মাছ ধরা। পরে অবশ্য অভ্যস্ত হয় কৃষিকাজেও। প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতির সন্তান মাওরিরা। নিউজিল্যান্ডের নাম তাদের কাছে আতিরোয়া, যার অর্থ ‘দীর্ঘ শ্বেতমেঘের দেশ’। তবে, এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সারা মুখ জুড়ে করা ট্যাটু। পুরুষ-মহিলা কিংবা উঁচু-নিচু স্তরভেদে বদলে যায় নকশার ধরন। ট্যাটুর এই সংস্কৃতিকে তাঁরা বলে ‘মোকো’ (Moko)। 

ইতিহাসের প্রাচীন সভ্যতাগুলির মতো পারলৌকিক জীবনের নিয়মনীতিতেও কিছু স্বাতন্ত্র্য ছিল ‘মাওরি’-দের। মৃত্যুর পর তাঁরা সংরক্ষণ করে রাখত মৃত ব্যক্তির মাথা। পদ্ধতিটিও ছিল অত্যন্ত অদ্ভুত। প্রথম ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হত মাথা। তারপর চোখ, মস্তিষ্কের মতো পচনশীল অংশগুলিকে বের করে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত বিশেষ এক ধরনের গাছের ছাল দিয়ে তৈরি আঠা। বেশ কয়েকদিন শোকানো হত রোদে। মুখের চামড়া অবিকৃত রাখতে ব্যবহার করা হত হাঙরের চর্বি দিয়ে তৈরি একপ্রকার তেল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতিতে তৈরি মাথাদের নাম ছিল ‘মোকোমোকাই’। প্রায় কয়েকশো বছর ধরে কিন্তু অবিকৃত থেকেছে ট্যাটুভরা মাথাগুলি। তবে, সমস্ত মাওরি-র বরাতে থাকত না এই সুযোগ। মূলত সমাজের উচ্চস্তরের ব্যক্তিরাই পেত এই ‘সম্মান’। কিংবা বিরোধী কোনো জনজাতিকে যুদ্ধে হারাতে পারলে তাদের নেতার মাথাকেও রাখা হত ‘মোকোমোকাই’ (Mokomokai) করে।

আঠারো শতক নাগাদ নিউজিল্যান্ডের বন্দরে এসে পৌঁছোয় ইউরোপীয়দের জাহাজ। ক্রমে তারাই হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। ১৭৭০ সালে ইংল্যান্ডের জোসেফ ব্যাঙ্কস নামের এক বোটানিস্টের চোখে পড়ে ‘মোকোমোকাই’-এর দিকে। এক বয়স্ক মাওরি-র নৌকো থেকে পাওয়া হয় তিনটি মাথা। ট্যাটুওয়ালা মাথাগুলির আশ্চর্য গল্প শুনে ব্যাঙ্কস সাহেবের ইচ্ছা জাগে সেগুলি সংগ্রহের। ইউরোপবাসী তখনও নিউজিল্যান্ডের রহস্য সম্বন্ধে সেরকম অবগত নয়। তিনি প্রথমে সম্মানজনকভাবে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু রাজি হয়নি বৃদ্ধ ব্যক্তিটি, যতই হোক এগুলি তাদের ঐতিহ্যের চিহ্ন। শেষে অবশ্য ইংরেজের বন্দুকের সামনে বেচতে বাধ্য হন তিনি। ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য হলেও, আসলে দরজা খুলে গেল ইউরোপীয়দের আরেকটি ঘৃণ্য ব্যবসার। অবশ্য, মূল্য পেয়েছিলেন তিনি। মাথার বদলে দুটি অন্তর্বাস।

এদিকে খবর রটে যায় ইউরোপে। নতুন ‘মজা’র সন্ধান পেল তারা। দলে দলে লোক ছুটে এল ‘মোকোমোকাই’ কিনতে। আর মাওরিদেরও বাধ্য করা হল বেচতে। স্বাভাবিকভাবেই একসময় কমতে শুরু করে ‘মাথা’-র সংখ্যা। ইতিমধ্যে চালু হয়েছে সেই চিরাচরিত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। নিউজিল্যান্ডের উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেই থাকত, প্রাণও যেত উভয়পক্ষের। ইউরোপীয়রা মাওরি-দের হাতে তুলে দিল বন্দুক। যত বেশি শত্রু মারা যাবে, তত বেশি তৈরি হবে ‘মোকোমোকাই’। পুরনো ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে শুরু হল বন্দিদের বা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতদের মাথা সংরক্ষণের কাজ। বাদ দেওয়া হত না বিরোধী গ্রামের মহিলাদেরও। প্রায় কুড়ি থেকে চল্লিশ হাজার মানুষ মারা গেছিল উপজাতিদের আভ্যন্তরীণ এই যুদ্ধে। অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে উঠল ইউরোপীয়দের ব্যবসা। রীতিমতো কালোবাজারি চলতে লাগল ‘মাথা’ কেনাবেচা নিয়ে।

আরও পড়ুন
তারাভরা আকাশের নিচে, ‘ডার্ক স্কাই নেশন’ হওয়ার পথে নিউজিল্যান্ড

১৮৬৪ সালে নিউজিল্যান্ডে এসে পৌঁছোন হোরাশিও গর্ডন রোবলে (Horation Gordon Robley) নামের এক ব্রিটিশ সৈনিক। তার আগে কিছুদিন কাটিয়ে গেছেন ভারতে ও মায়ানমারের। বন্দুকের পাশাপাশি সমানভাবে হাত চলে কাগজ-পেনসিলে। আঁকার প্রতিভা পেয়েছিলেন মায়ের থেকে। মায়ানমারে থাকাকালীন এক বৌদ্ধ পরিব্রাজকের সংস্পর্শে এসে শেখেন ট্যাটু বানানোর শিল্পকর্ম। আর নিউজিল্যান্ডে মাওরি গোষ্ঠীকে দেখে তিনি যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। না, কোনো নৃশংস অর্থে নয়। জেগে উঠল ভিতরের শিল্পীসত্তা। দীর্ঘ সময় কাটালেন তাদের সঙ্গে, বুঝলেন বিভিন্ন ধরনের ট্যাটুর বৈশিষ্ট্য। মাওরিদের মধ্যেও ছোটো ছোটো পার্থক্য আছে। তখন ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক অবস্থানের পরিচয় হয়ে ওঠে মোকো। পুরুষদের মুখজোড়া মোকো থাকলে, মহিলাদের থাকত শুধু মুখের নিচের অংশে। তার বাহারও আলাদা। সময় পেলেই পাতার পর পাতা জুড়ে আঁকতেন মাওরিদের মোকো-মুখের অবয়ব। লিখে ফেললেন গবেষণাসমৃদ্ধ দুটি বইও। 

আরও পড়ুন
নিউজিল্যান্ডের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব, দেশজুড়ে বিতর্কের পরিস্থিতি

কিন্তু শুধু ছবি দিয়ে তো ইউরোপের মানুষ বুঝতে পারবে না মাওরিদের শিল্পী পরিচয়ের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। এদেশ থেকে যাওয়া মোকোমোকাই-এর অধিকাংশই বন্দি ব্যক্তিগত ‘কালেকশন’-এ। অতএব, তাকেও নিতে হল সেই এক রাস্তা। ঘুরপথে সংগ্রহ করেন পঁয়ত্রিশটি মাথা। ১৮৯৬-তে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘মাওরি ট্যাটুইং’। মৃত্যুর কিছু বছর আগে ১৯০৮ সালে নিউজিল্যান্ড সরকারকে হাজার পাউন্ডে বিক্রিও করে দিতে চান ‘মোকোমোকাই’গুলি। তারা রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিরিশটি মাথা কিনে নেয় নিউ ইয়র্কের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়াম। আজও, সেখানেই সংরক্ষিত সেগুলি। 

মাওরিদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল ‘হাকা’ নাচ। যা একপ্রকার যুদ্ধনৃত্য। সমবেত স্বরে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে তারা এগিয়ে যায় বিরোধীপক্ষের দিকে। এখনও নিউজিল্যান্ডের রাগবি টিম খেলার আগে নাচে ‘হাকা’। আর ওই দিয়েই নষ্ট করে দেওয়া হয় বিরোধীদের অর্ধেক আত্মবিশ্বাস।

Powered by Froala Editor