আস্ত দোকান ভেঙে চুরমার, মহিলাদের কাণ্ডে অবাক ‘ভারতীয় পাদ্রি’ সুকুমার রায়

১৯১১ সালের অক্টোবর মাস। ‘এস এস আরাবিয়া’ জাহাজে বসে আছেন এক যুবক। চোখে মুখে তারুণ্যের সঙ্গে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। গন্তব্য বিলেত; প্রেসিডেন্সি থেকে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি পেয়েছেন তিনি, অতএব উচ্চশিক্ষার জন্যই সাগরপাড়ি দেওয়া। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা কি একেবারেই হচ্ছে না? নিশ্চয়ই হচ্ছে। বাড়ি ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে একা একা অজানা এক দেশে যেতে হচ্ছে যে। সেইসবের মধ্যেও তটস্থ সেই যুবক। মনে পড়ছে ‘সন্দেশ’-এর কথা, বাড়ির একতলায় থাকা প্রেসের সেই আওয়াজ। আর সেই যন্ত্র ও কলকব্জার সঙ্গে আরও ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার জন্যই তো বিলেত পাড়ি দিচ্ছেন রায়বাড়ির বড়ো ছেলে সুকুমার রায়!

নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো চোখের সামনে ভেসে আসবে কত দৃশ্য। কখনও ‘পাগলা দাশু’, ‘খুড়োর কল’; কখনও আবার ‘হাঁসজারু’, ‘বকচ্ছপ’-এর স্রষ্টা পাড়ি দেন ‘অবাক জলপান’-র দেশে। আপামর বাংলার শৈশবকে এভাবেই ভরিয়ে রেখেছেন সুকুমার রায়। শুধু কি শিশু? বড়োরাও কি একইভাবে আনন্দ পান না? স্বল্প জীবনে কত ভূমিকায় নেমেছেন তিনি— কবি, প্রকাশক, চিত্রশিল্পী, ছড়াকার, বিজ্ঞানী, নাট্যকার… এই লিস্টি থামার নয়। আর পারিবারিক সূত্রে পেয়েছিলেন আরও একটি গুণ। আর সেই সূত্রেই পাড়ি দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে… 

ছোটো থেকেই দেখেছেন বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কাজের পরিবেশকে। ২২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িটার একতলায় চলত প্রেসের ঘটর ঘটর আওয়াজ। ছেপে বেরোচ্ছে ‘সন্দেশ’। আর ঘরে গেলেই বাবার নিজস্ব ডার্করুম। চলছে নানারকমের পরীক্ষা। এইভাবেই কাজ করতে করতে একদিন নিজের উদ্যোগেই হাফটোন পদ্ধতিতে ছবি ছাপার কৌশল শেখেন। বঙ্গদেশ তো বটেই, গোটা ভারতে সেই সময় এমন উন্নততর পদ্ধতির প্রয়োগ কেউ করেনি। একমাত্র ইউরোপেই এই হাফটোন পদ্ধতি নিয়ে চলছে পড়াশোনা। দেশ-বিদেশের গবেষণাপত্রে তখন উপেন্দ্রকিশোরের নাম। আর এমন পরিবেশই টেনেছিল সুকুমার রায়কেও। ছবি আঁকার সহজাত দক্ষতা তো ছিলই; সেইসঙ্গে ফটোগ্রাফির ওপরেও মন বসল তাঁর।

উপেন্দ্রকিশোর চেয়েছিলেন, এই মুদ্রণ শিল্প নিয়ে বাংলার ভেতর একটা বিপ্লব তৈরি হোক। আরও উন্নত হোক ছাপাখানা। বাবার এমন চিন্তা সঞ্চারিত হয়েছিল ছেলের মধ্যেও। সেই সূত্রেই পাড়ি দেওয়া বিলেতে। ১৯১১ থেকে ১৯১৩— টানা দুবছর সেখানে ছিলেন সুকুমার রায়। তবে তাঁর জীবনের এই পর্বটিও নিজের মতোই ঝলমলে। লেখায় যেমন একটা অদ্ভুত রস বা ‘উইট’ থাকত, তেমনই জীবনকেও সেইভাবেই দেখেছেন তিনি। লন্ডনে গিয়ে সুকুমার ভর্তি হন স্কুল অফ ফটো এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফিতে। তবে ক্লাসের থেকেও বেশি সময় যেত স্টুডিও ও ল্যাবরেটরিতে। একটু একটু করে শিখতে লাগলেন কাজ। মাথায় ঘুরছে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’-এর কথা। ফিরে গিয়ে এই সবকিছু কাজে লাগাতে হবে যে… 


একবছর পর চলে গেলেন ম্যানচেস্টার। সেখানে স্কুল অফ টেকনোলজিতেও মুদ্রণ শিল্প ও ফটোগ্রাফির চর্চা চালিয়ে গেলেন সমানে। তবে এই প্রতিষ্ঠানে এসে পেয়ে গেলেন বেশ কিছু ভারতীয়কে। বাড়িতে ঘনঘন চিঠি লিখে জানাচ্ছেন নতুন প্রযুক্তির কথা। উপেন্দ্রকিশোরকে জানালেন হাফটোন পদ্ধতি নিয়ে আরও বিস্তারিত জানছেন তিনি। ভবিষ্যতে যে এই বিষয়ই গবেষণায় যেতে পারেন, সেই ইঙ্গিতও ধরা পড়েছিল এই সব চিঠিতে। ওখানে থাকতে থাকতেই ব্রিটিশ জার্নাল অফ ফটোগ্রাফিতে প্রকাশ পায় ‘পিন হোল থিয়োরি’ নিয়ে তাঁর বিশেষ লেখা। প্রায় একই সময় বিখ্যাত পেনরোজ অ্যানুয়ালে প্রকাশিত হয় সুকুমার রায়ের আরও দুটি লেখা। তবে এবারের মূল বিষয় কিন্তু হাফটোন পদ্ধতি। যে পদ্ধতির চর্চা ছোটো থেকে দেখে এসেছেন বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোরের আবিষ্কৃত পদ্ধতির প্রয়োগও দেখান সেখানে। আশ্চর্য লাগে, এই পেনরোজ অ্যানুয়ালেই উপেন্দ্রকিশোরের হাফটোন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। আর পরে সেখানেই হাজির হন পুত্র সুকুমার; বিষয় কিন্তু একই… 

আরও পড়ুন
ফ্রাঙ্ক বাউমের বই থেকে ছবি নিয়ে ‘আবোল তাবোল’-এ ব্যবহার করলেন সুকুমার রায়

কেবলই কি ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণ? এর বাইরেও যে সুকুমার রায়ের গণ্ডি ছড়ানো। যে সময়টার কথা হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথ বিলেতে। নোবেল পাওয়ার মুহূর্তও ঘনিয়ে আসছে। আর তিনি ছাড়াও উপস্থিত আছেন কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশরা। এই দলেই ভিড়ে গেলেন সুকুমার রায়ও। পড়াশোনা বাদ দিয়ে নির্ভেজাল আড্ডা চলতে লাগল। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে হাজির হত সাহিত্যও। আর সুকুমার ছাড়া বাংলা সাহিত্য কি ভাবা যায়? নিজের স্বভাবসিদ্ধ রস খাঁচা খুলে বেরিয়ে পড়ত যখন তখন। জানা যায়, এই সময়ই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কবি ইয়েটস, ব্রিজেসের সঙ্গে। আর সেই সেতু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছোটো থেকেই কবিগুরুর গুণমুগ্ধ সুকুমার রায়। আর কলকাতা থেকে এতদূরে এসেও কাছে পেয়ে যাবেন তাঁকে— এ যে পরম পাওয়া। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট সোসাইটি’তে এই সময় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন তিনি। সুকুমারের ‘দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ’-এর ধারণার সম্মুখীন হয় ব্রিটিশ সমাজও। 

সুকুমার রায়ের চিঠিপত্রে ধরা পড়েছে সেই সময়ের ইংল্যান্ডের চিত্র। নিজের রসভঙ্গিতেই সেসব পরিবারের কাছে লিখেছিলেন তিনি। মাঘের পরিবেশ তখন সবে ছোঁয়া দিয়েছে লন্ডনে। ওয়ালডর্ফ হোটেলে প্রায় ২৫০ জন মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। এমন পরিবেশে একটু একত্রিত না হলে হয় নাকি! সেই পার্টিতে উপস্থিত হয়েছিলেন স্বয়ং সুকুমার রায়ও; তবে কোট-প্যান্ট নয়, চোগা-চাপকান পরে বাকিদের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আর তাই দেখে নাকি সুকুমার রায়কে ‘ভারতীয় পাদ্রি’ ঠাওরেছিলেন বাকিরা! এমন ‘বিভ্রাট’ ভারী আনন্দ দিয়েছিল তাঁকে। 

আরও একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করার মতো। সেই সময় ইংল্যান্ডের মেয়েরা ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু এটা তো উচিত নয়! তাঁরাও নাগরিক, তাঁদেরকেও এমন অধিকার দিতে হবে। এই দাবি নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ মহিলারা। কখনও শোভাযাত্রা, বক্তৃতা, মিছিল আয়োজিত হচ্ছে; কখনও সেটাই চলে যাচ্ছে পাথর ছোঁড়াছুড়ির পর্যায়ে। সুকুমার রায় একবার দেখেন, তাঁর সামনেই একদল মহিলা একটি ঝাঁ চকচকে দোকান ভেঙে চুরমার করে দিল। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন হয়ে উঠেছিল তখন… 

আরও পড়ুন
প্রশ্নেই রয়েছে গলদ, আচার্য সুনীতিকুমারের ভুল ধরিয়ে দিলেন ছাত্র সুকুমার সেন

১৯১১ থেকে ১৯১৩— এই দুই বছর জীবনের অভিজ্ঞতাই শুধু নয়, আধুনিক মুদ্রণ শিল্পও নিয়ে এসেছিলেন বাংলার জন্য। কবি-ছড়াকার-নাট্যকারের পাশাপাশি বাংলার মুদ্রণ শিল্পে সুকুমার রায় যে অবদান রেখেছিলেন, তাকে ভুলে গেলে চলবে কী করে? হাফটোন ব্লক তৈরির ক্ষেত্রে নিজেই নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন সেখানে। সেসবই নিয়ে আসেন নিজেদের পারিবারিক প্রেসে। ইংল্যান্ডে থাকতে থাকতেই জড়িয়ে পড়েছিলেন রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সঙ্গে। পরে সেখানেই সাম্মানিক ফেলোশিপ পান সুকুমার রায়। এর আগে মাত্র একজন ভারতীয়ই এখানের ফেলো হয়েছিলেন। এইভাবেই নিজের ছাপ রেখে যান সুকুমার রায়। তাঁর রাজত্ব যে সমস্ত দিকেই, বাঘের মতো… 

তথ্যসূত্র—
১) ‘সুকুমার রায়’ / লীলা মজুমদার
২) ‘বলব যা মোর চিত্তে লাগে’, আবাহন দত্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘Remembering Sukumar Ray, the pioneering poet, illustrator and printer who fathered Satyajit Ray’, India Today

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা

More From Author See More