সর্বজয়ার কান্নায় রবিশঙ্করের সুর, মুগ্ধ সত্যজিৎ বদল এনেছিলেন যে দৃশ্যে

১৯৬২ সাল। মঞ্চে উঠে এলেন দুই শিল্পী। বাঁশিতে বাড শাঙ্ক, তবলায় কানাই দত্ত। সঙ্গে এলেন আরও একজন। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুটের স্বাস্থ্যবান শরীরটা মঞ্চে এসে বসল। হাতে তুলে নিল তাঁর প্রাণের সেতার। আঙুলের মূর্ছনায় ছলকে উঠছিল সমস্ত ব্যথা, দুঃখ। আস্তে আস্তে সবাই সেই আবহের অংশ হয়ে পড়লেন। পরে খেয়াল পড়ল, আরে! এই একই বাজনা তো আগেও শুনেছিল সবাই। তখনকার এক নবাগত পরিচালকের ছবিতে এই সঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন স্বয়ং সেতারবাদক। আজ সেটাই যেন অন্যভাবে ফিরে এল তাঁদের কাছে!

সেতারবাদক কি সেইসময় ফিরে গিয়েছিলেন সেইসব দিনে? তাঁর সুর ধরে গ্রামের পথ পেরোচ্ছে এক কিশোরী আর তার ভাই। তিনি যেন দেখতে পেলেন সেসব। এভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইম্প্রোভাইজেশন অন দ্য থিম মিউজিক ফ্রম পথের পাঁচালী’। এবার ওই নবীন পরিচালককে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না! হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায়। আর সেতারবাদকটি? তিনিও বাঙালি, বিশ্বনাগরিক— পণ্ডিত রবিশঙ্কর।

সত্যজিতের সঙ্গে রবিশঙ্করের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আরেক বাঙালি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সশরীরে নয়, অক্ষরের মাধ্যমে। সত্যজিৎ তাঁর জীবনের প্রথম ছবিটি করছেন তাঁরই উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র একটি অংশ থেকে। সেখানে বাংলার সুর, গ্রামের সুর দেবেন রবিশঙ্কর, এমনটাই শুরু থেকে তাঁর মাথায় ছিল।

রবিশঙ্কর তখন এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। সেখানেই চলে যান সত্যজিৎ। ততদিনে কিছু ছবিতে কাজ করে ফেলেছেন রবিশঙ্কর। সেতারবাদক হিসেবেও পরিচিত হচ্ছেন। সঙ্গীতের মধ্যেই যেন থাকেন সবসময়। ঘরে ঢোকার পর সত্যজিৎকে সরাসরি বললেন, “তোমার ছবির একটি সঙ্গীত রূপ ভেবে রেখেছি।” বলার পরই একটি সুর শোনাতে আরম্ভ করলেন। সত্যজিৎ তো অভিভূত! ঠিক এমনটাই তো চাইছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র জন্য। পুরো ছবিতে কোথায় কোথায় সঙ্গীত থাকবে, সেটাও একবার দেখিয়ে নিতে হবে। তারপর মহড়া, রেকর্ডিং ও শেষে এডিটিং।

আরও পড়ুন
'পথের পাঁচালী'র সেটে আলাপ, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বললেন সৌমেন্দু রায়

এখানেই এল প্রথম ও প্রধান মুশকিল— সময়। রবিশঙ্কর মাত্র একটা দিন সময় দিতে পারবেন। তার মধ্যেই পুরো সঙ্গীতের কাজ সারতে হবে। ব্যাপারটা রীতিমতো মুশকিলের। কিন্তু হার মানার পাত্র যে সত্যজিৎ নন! তাঁর মাথায়ও গিজগিজ করছে অজস্র ভাবনা। একটা ব্যাপারে রবিশঙ্কর আর সত্যজিতের ভাবনা মিশে গিয়েছিল; এই কাজটি গতানুগতিকের মতো হবে না। দৃশ্যের গভীরে গিয়ে ওই সুর বের করে আনতে হবে। যাই হোক, ওই একটি দিনেই সমস্তটা ব্যবস্থা করা হল। সেইদিনই ছবিটার কিছুটা দেখলেন রবিশঙ্কর। এবার তিনি অভিভূত হলেন। সমস্ত যন্ত্রশিল্পীদের বলে দেওয়া হল স্টুডিওতে চলে আসার জন্য। সেতার, বাঁশি, তারসানাই, চমং আর কাচারি— এ-ই ছিল সরঞ্জাম। বাকিটা, সুরের অনন্ত ক্যানভাস…

২৬ আগস্ট, ১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমাটি। আজ থেকে ঠিক ৬৫ বছর আগের একটা দিন ছিল সেটা। এই সিনেমার একটি দৃশ্যের কথা অনেক সমালোচক, পরিচালকেরা বলে থাকেন মাঝেমধ্যে। দৃশ্যটা যখন আসে, তখন দুর্গা মারা যায়। হরিহর বাইরে থেকে ঘরে ফিরছেন; সর্বজয়ার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন শাড়ি। যা দুর্গার নাম করে এনেছিলেন। সেই দৃশ্যে প্রথমে সর্বজয়ার কান্না রেখেছিলেন সত্যজিৎ। পরে মনে হল, এমনটা কি দরকার? সমস্ত কান্নার কি শব্দ হয়? বিষাদের নিজস্ব কিছু সুর থাকে না? তাহলে এখানে কান্নার পরিবর্তে সুরমূর্ছনা দিলেই তো হয়! সেই সুরও ধরতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ। তিনি আর রবিশঙ্কর একসঙ্গে আলোচনা করছিলেন। ওইদিন, গোটা রাত জেগে চলল রেকর্ডিংয়ের কাজ। ওখানে বসেই তৈরি হচ্ছে স্বরলিপি, চলে যাচ্ছে শিল্পীদের হাতে। অলোক দে’র বাঁশি বেজে উঠছে, রবিশঙ্করের সেতারের ঝংকার— ক্লান্তি কখনও আসে এর মধ্যে!

শেষের সেই বিলাপের দৃশ্যটায় সুর বসিয়েছিলেন সত্যজিৎ নিজে। বাকিটা রবিশঙ্কর আর দক্ষিণামোহন ঠাকুরের জাদু-ছোঁয়া। টানা দু’মিনিট ধরে চলে এই সুর। তারসানাইয়ে সেই বিলাপ তুলেছিলেন দক্ষিণামোহন স্বয়ং। রাগটা ঠিক করে দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর নিজেই, পটদীপ।

কিন্তু একটি জায়গায় সুর দেওয়া হয়নি। রবিশঙ্করের ব্যস্ততা তাঁকে বাধ্য করে এখানে থামতে। তবে সেই শেষের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র। তিনি যেমন ছিলেন অন্যতম সেরা সিনেমাটোগ্রাফার, অন্যদিকে সেতারেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনিই সেই যাত্রা রক্ষা করেছিলেন। দৃশ্যটি ছিল মিঠাইওয়ালার মিঠাই ফিরি করা। তবে রবিশঙ্কর পড়লেন মহা মুশকিলে। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর বেশ কিছু দর্শক যখন ওই ‘মিঠাইওয়ালা’র দৃশ্যের সুরটি বাজাতে বলেন, তখন একটু ঘাবড়েই যান। পথের পাঁচালী তখনও দেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর। কোনোরকমে সামলে ওঠেন সেই অবস্থা। কিন্তু চিরকালের মতো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় সত্যজিৎ রায় আর রবিশঙ্করের মধ্যে।

শুধু পথের পাঁচালীই নয়, এই দুই বাঙালির সুরের যাত্রা এগিয়ে গিয়েছিল ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ ও ‘পরশপাথর’-এর দিকে। দুই স্রষ্টার রসায়নে তৈরি হয়েছিল একের পর এক ম্যাজিক! তখনই সত্যজিৎ রায়ের মাথায় আরও একটা ভাবনা খেলা করে। এটার কেন্দ্রেও রবিশঙ্কর, কিন্তু এখানে তিনি আর সুরকার নন। রবিশঙ্করের জীবন, সঙ্গীত, সুর এইসব কিছু সিনেমার পর্দায় ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই ডকুমেন্টারির জন্য চিত্রনাট্যও তৈরি করে রেখেছিলেন নিজের খাতায়। শুধু লেখা নয়, ছবি এঁকে দৃশ্য বুঝে বুঝে এগিয়ে রেখেছিলেন পুরোটা। কিন্তু, সেটা বড়ো পর্দার মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত আর করা হয়ে ওঠেনি রবিশঙ্করের ওপর এই ডকুমেন্টারি। কিন্তু চিত্রনাট্যটি যত্ন করে রাখা ছিল। পরে বই আকারে প্রকাশ করা হয় এটি। মৃত্যুর পরও এইভাবেই জড়িয়ে ছিলেন দুই কিংবদন্তি সৃষ্টিকর্তা।

Powered by Froala Editor