'মাসিক রোমাঞ্চ' পত্রিকার নারী-গোয়েন্দা দময়ন্তী

দময়ন্তী দত্তগুপ্ত, মধ্যবয়স্ক বিবাহিত ভদ্রমহিলা। পেশায় ইতিহাসের অধ্যাপিকা, কিন্তু তার আরেকটি পরিচয় সে গোয়েন্দা। তার পেশা ও নেশা যে বিচ্ছিন্ন নয়, লেখক মনোজ সেন নিজেই ‘দময়ন্তী সমগ্র : প্রথম খণ্ড’-এর ভূমিকাংশে তা জানান— ‘ঐতিহাসিক যেমন কোনো প্রাচীন সভ্যতার ভগ্নাবশেষ, কিছু ধূসর পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া পাতা অথবা আপাত-কাল্পনিক লোকস্মৃতি আর উপকথা থেকে একটি ঐতিহাসিক সত্যকে খুঁজে বের করে আনেন, তেমনি কোনো অপরাধের উলটোপালটা সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে একটি যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান প্রতিষ্ঠিত করে দময়ন্তী’।

স্বামী সমরেশ, বিদেশি ফার্মের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তাকে দেখা যায় দময়ন্তীর অঘোষিত সহকারীর ভূমিকায়। নারী-গোয়েন্দা ও পুরুষ-সহকারীর ব্যতিক্রমী ছকে প্রচলিত সামাজিক ক্ষমতাতন্ত্রটি উলটে দেবার একটি অভিনব প্রয়াসটি চমকপ্রদ। লেখক, সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় জানাচ্ছেন, ‘মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষে ওকালতি করা’ তাঁর অবশ্যই একটা উদ্দেশ্য, কিন্তু এ-ও জানাচ্ছেন, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটিই বড়ো করে দেখাতে তিনি আগ্রহী। তাই দময়ন্তীর ক্ষেত্রে দেখা যাবে— ‘এক বা একাধিক পুরুষ সবসময় তাকে পেছন থেকে সাহায্য করে গেছে’।

গোয়েন্দা হিসেবে নারীদের উঠে আসা পুরুষতান্ত্রিক অপরাধ-সাহিত্যপরিসরে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার আখ্যানে অপরাধ, হত্যা, চুরি ও অন্য নানাবিধ ‘পাপকথা’ যে ‘কোমলমতি’ নারীদের জন্য উপযুক্ত নয়— এমন একটা ধারণা বহুদিন বাংলা সাহিত্যেও কাজ করেছে বলে, নারীর মৌলিক রচনা উনিশ-শতকে খুঁজে পেলেও বিশ-শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আগে নারীকে প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা হিসেবে কেন্দ্রে রেখে লেখা কোনও ‘ক্রাইম-কাহিনি’ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ-শতকের গোড়ায় বাংলা গল্পের কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরণে নারীদের গোয়েন্দাগিরির কথা এলেও, তা মুখ্যত ঘরোয়া পরিসরের সাধারণ নারীরই গল্প, ‘নারী-গোয়েন্দা’র প্রতিষ্ঠিত সামাজিক পরিচয়টি তাঁদের ছিল না। বাংলা ক্রাইম-কাহিনিতে প্রতিষ্ঠিত নারী-গোয়েন্দার আগমন প্রভাবতী দেবীর ‘গুপ্তঘাতক’ (১৯৫২) গল্পের মাধ্যমে বলে মনে করা হয়। প্রভাবতী দেবীর কৃষ্ণাকে দিয়ে ধারাবাহিকভাবে নারী-গোয়েন্দাদের রহস্য সমাধানের সেই-যে শুরু, তারই ধারায় বিশ-শতকের শেষভাগে ‘সরল অঙ্কের ব্যাপার’ (১৯৭৩) গল্পের মাধ্যমে মাসিক ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার পাতায় আবির্ভাব হল ‘রহস্যসন্ধানী দময়ন্তী’র। 

গল্পগুলিতে অপরাধ বলতে মুখ্যত খুন— তবে ব্ল্যাকমেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাবোটাজ ইত্যাদিও কিছুক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। ‘সরল অঙ্কের ব্যাপার’, ‘ইজ্জত’, ‘নকল হীরে’ এবং ‘রাজমহিষীর রহস্য’ ইত্যাদি গল্পে খুনের মোটিভ হচ্ছে তুলনামূলকভাবে সরল— লোভ, ঈর্ষা বা যৌন-ঈর্ষা ইত্যাদি। আপাতভাবে জটিল দুটি খুনের মোটিভ আসছে ‘পর্বতো বহ্নিমান’ আর ‘অন্ধ তামস’ গল্পে, যেখানে খুন করা হচ্ছে খানিকটা আত্মরক্ষার্থে; আততায়ীর কাছে সেই পথ বেছে নেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকছে না। বস্তুত, 'অপরাধের পিছনে অপরাধ' এই গল্পে গোয়েন্দার অন্বিষ্ট। দময়ন্তীর ‘ক্লু’ মুখ্যত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বের করে আনা তথ্য, অপরাধের ঘটনাস্থলে ঘোরাঘুরি করে সংগৃহীত কোনো প্রত্যক্ষগ্রাহ্য প্রমাণাদি (empirical evidence) ততটাও নয়। আবার বারকয়েক কলকাতার বাইরে বেড়াতে গিয়ে রহস্য-সমাধান করলেও এবং আক্ষরিকভাবে ঘরের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে বসে না-থাকলেও কার্যপদ্ধতিগতভাবে তাকে আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ বলতে বাধা নেই। বাড়িতে থাকাকালীন তার কাছে ক্লায়েন্টরা আসেন হয় নিজে থেকে, নাহলে পুলিশের মারফত। এখানে স্বামীবন্ধু সি আই ডি অফিসার শিবেন সেন, সাহায্য-প্রার্থনায় মাঝেমাঝে সশরীরে দময়ন্তীর কাছে এসে বা ক্লায়েন্ট পাঠিয়ে পুলিশের সরকারি অবস্থানের সঙ্গে বেসরকারি-গোয়েন্দার এই বোঝাপড়ার কাজটি সহজ করেন। পুলিশ সাধারণত একটি ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় এবং তাকেই মান্যতা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে; কিন্তু দময়ন্তী শেষাবধি সেই ভুল ধরিয়ে পুলিশকে ‘শুধরে’ দেয়। 

পুলিশ-গোয়েন্দা দ্বন্দ্বের পাশাপাশি পুরুষ-নারী তর্কেরও একটা পরিসর তৈরি হয়— ‘সূর্যগ্রহণ’ গল্পে দময়ন্তীকে গোয়েন্দাগিরির প্রসঙ্গে পুলিশ অফিসার জয়ন্ত বলে— ‘মেয়েছেলের লাইন এসব নয়’। সেই জয়ন্তও পরিশেষে দময়ন্তীকে মান্যতা দিতে বাধ্য হয়। অনেক সন্দেহভাজন বা অপরাধীও কিছুক্ষেত্রে ‘মেয়েছেলে’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে গোয়েন্দার ‘নারীত্বে’র প্রশ্নটি তুলে দময়ন্তীকে বিদ্ধ করে। দময়ন্তী কিন্তু রহস্য-সমাধানে সাফল্যের অনুচ্চার বিজয়ঘোষণার মাধ্যমেই সেই তর্ককে অতিক্রম করে। অপরাধজগত ও তার প্রশাসন বিভাগ— দুইই মূলত পুরুষপ্রধান, এই পরিসরে একজন নারী তার লিঙ্গপরিচয়ের নিরিখে যে অপরায়নের সম্মুখীন হয় সেই বয়ানটিও তাই হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ। 

নারীর সামাজিক নির্মাণের বিষয়টি দময়ন্তীর গল্পগুলিতে বিশষ গুরুত্ব পায়। প্রায় সব কটি গল্পেই দেখা যায়, ‘নারীর ইনটিউশান’— বিষয়টি নানাভাবে দময়ন্তীর ক্রাইম-ডিটেকশানে সহায়ক হয়ে উঠছে। নারীত্বকে সমাজ সাধারণত দুর্বলতার সঙ্গে সমীকৃত করে দেখতেই আগ্রহী, কিন্তু এখানে বুদ্ধিবলের মতোই ‘নারীত্ব’ও একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যা গোয়েন্দাকে সুবিধা করে দিচ্ছে। তবে এই আপাত-প্রগতিবাদের একটা বিপরীত-পিঠও উপস্থিত। ‘প্রথম পাপ’ গল্পে দেখা যায়, স্বনির্ভর হলেও স্বামী সমরেশের উপস্থিতি ছাড়া দময়ন্তী ‘কনফিডেন্স’ পায় না। কার্যত এই ‘পুরুষ-সহায়তা’ বিষয়টি নারীর নির্মাণে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে, এমনকি স্বয়ং গোয়েন্দার ক্ষেত্রেও। ‘অন্ধ তামস’ এবং ‘ইজ্জত’ গল্পে দময়ন্তীকে যথাক্রমে কুকুর ও ভূতের ভয় পেতে দেখা যায়, এবং দুক্ষেত্রেই স্বামীর উপস্থিতি তাকে আশ্বস্ত করে। ‘ভগ্ন অংশ ভাগ’ গল্পে যখন তার পুরুষ-সঙ্গীরা (সমরেশ ও শিবেন) ক্লায়েন্টের বাড়িতে হুইস্কি-সহযোগে আপ্যায়িত হয় দময়ন্তী তখন চেয়ে নেয় কফি। ওই গল্পেই দময়ন্তীর  রন্ধন-পটুত্বের কথাও উঠে আসে— এসব তাকে ‘আদর্শ গৃহিণী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা-দানের প্রয়াস ভাবলে খুব ভুল হয় না। 

খলনায়িকা বা ভ্যাম্প চরিত্রের নির্মাণ-প্রকল্পটিও দময়ন্তীর গল্পে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্ণনা অনুযায়ী শরীরী-বৈশিষ্ট্যে নজরকাড়া, শরীরি আবেদনময়ী এই চরিত্রগুলি কোনো-না-কোনো ভাবে অপরাধপ্রবণ। ‘প্রথম পাপ’-এ মালবিকা, ‘পর্বতো বহ্নিমান’ গল্পের শর্মিষ্ঠা ও মুনিয়া, ‘ইজ্জত’ গল্পের বকুল ও রেবেকা আচারিয়া, ‘অন্ধ তামস’-এ গিরিজা, ‘নীলকান্তপুরের হত্যাকাণ্ড’-তে বীথিকা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয় এরা তদন্তাধীন-অপরাধ-সংঘটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত অথবা তাদের কোনো নীতিহীনতার প্রশ্নটি বড়ো হয়ে উঠে তাদের মৃত্যু বা দুর্ভোগের কারণকে ন্যায্যতা দেয়। কিন্তু ‘অন্ধ তামস’-এর দেওরাজ, ‘নকল হীরে’র সাত্যকি একইরকম নীতিহীনতা ও লাম্পট্যের উদাহরণ নিয়েও বিশেষ প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। ‘শরীরী বৈশিষ্ট্যে উদগ্র’ এবং ‘নারী’ বলেই সামাজিক নৈতিকতার কাঠগড়ায় একভাবে এদের দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় কিনা— প্রশ্ন থেকে যায়। গল্পগুলির প্লটে যে বিত্তশালী ও বনেদী বাড়ির দাম্পত্যসমস্যার ক্ষেত্রগুলি উঠে আসে— সেখানে রেবেকা, বীথিকা, দীপান্বিতারা ও তাঁদের স্ব-স্ব স্বামীদের সঙ্গে একই বাড়িতে আলাদা-আলাদা ঘরে বসবাস করেন, এঁরা প্রত্যেকেই, কেউ খুন করেন বা খুন হন। আদর্শ-গৃহিণীর ইমেজটি থেকে চ্যুত হওয়া পরিণতি হিসেবে খুব ভালো কিছু যে নয়— এমন একটি অনুচ্চার ঘোষণাও এখানে থাকে। সব মিলে ‘ভালো নারী বনাম খারাপ নারী’র একটি যুগ্ম-বৈপরীত্য এভাবেই সমস্ত গল্পগুলি জুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। ‘প্রথম পাপ’, যদিও সবদিক থেকেই ব্যতিক্রমী আর ছকভাঙা একটি অপরাধ-আখ্যান। কেন— তা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন।

বাংলা-সাহিত্যের পূর্বের নারী-গোয়েন্দাদের থেকে দময়ন্তী একটু আলাদা। প্রথমত, নারী-গোয়েন্দার ধারায় প্রথম তারই ‘আর্থিক স্বনির্ভরতা’র উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, গল্পের নিরিখে পূর্বের নারী-গোয়েন্দাদের টার্গেট-রিডার অধিকাংশতই শিশু-কিশোররা হওয়ায় ক্রাইম-আখ্যান থেকে প্রাপ্তবয়স্কতার ছাপ প্রায় অপসারিত। অ্যাডভেঞ্চার বা বুদ্ধির খেলাই সেখানে প্রধান, কাহিনিতে অপরাধের বহুকৌণিক সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার একটা কারণও বটে। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ থেকে প্রভাবতী দেবীর ‘কৃষ্ণা’ ও ‘শিখা’ এবং সন্দেশ-এ প্রকাশিত ‘গোয়েন্দা গণ্ডালু’র ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু, জটিল মনস্তত্ত্ব থেকে সমলৈঙ্গিক সম্পর্ক— সাত-আটের দশক জুড়ে দময়ন্তীর কাহিনির প্লটে উঠে এসেছে সবই।

মাসিক রোমাঞ্চ পত্রিকার জনপ্রিয়তম লোগো

 

নারী-গোয়েন্দা হিসেবে দময়ন্তী-আখ্যান ‘পাল্প’-পত্রিকা মাসিক রোমাঞ্চ-এর পাতায় প্রকাশিত হওয়ায় একদিকে মূল-ধারার ‘রুচিশীল’ সাহিত্য ও অপরদিকে শিশুসাহিত্যের বাইরে এটি একটি বিকল্প পরিসর পায়, যা নারী-গোয়েন্দার ক্ষেত্রে অভিনব ছিল। সেই স্বাধীনতার সুবাদেই, বাস্তবোচিত ভাবে অনৈতিক অপরাধের একটি অন্যতম মোটিভ যে যৌন-ঈর্ষা— তা এখানে আড়াল করার প্রচেষ্টা করতে হয়নি। জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যার পর্যাপ্ত সুযোগ গ্রহণ করেছে, এবং যৌনতায় মুড়ে ‘আকর্ষণীয়’ করে তোলার অনাবশ্যক চেষ্টাতেই হয়তো সাহিত্য-নির্মাণ থেকে করেছে বহুদূরবর্তী। 

গঠনগতভাবে ধ্রুপদী গোয়েন্দা-গল্পের একটা পূর্বছক আছে। মোটের উপর, গোয়েন্দা-গল্পের এই ধাঁধার চরিত্র গঠনগতভাবে দময়ন্তীর গল্পে রক্ষিত হয়। বুক-ফার্ম প্রকাশনী দময়ন্তীর গল্পগুলি আগের শতকের ‘রোমাঞ্চ’ এবং অন্যান্য আরো কিছু পত্রিকার পাতা থেকে পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এবারের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিতব্য ‘দময়ন্তী সমগ্র : চতুর্থ খণ্ড’ তাই পাঠকদের মন জয় করতে পারে কিনা সেটাই দেখার।

প্রচ্ছদ : মাসিক রোমাঞ্চ শারদীয় সংখ্যায় (৫৮ বর্ষ, ১৯৮৯) দময়ন্তীর গোয়েন্দা-কাহিনির হেডপিস 

Powered by Froala Editor