বারোয়ারি গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী : ‘বাংলার শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ’

(প্রথম পর্ব)

‘বারোয়ারি উপন্যাস’ ব্যাপারটা অনেকেরই অপরিচিত নয়, কিন্ত ‘বারোয়ারি গোয়েন্দা’? অন্ত্য উনিশ-শতকের জনপ্রিয় সাহিত্যের পরিসরে ‘বারোয়ারি উপন্যাস’ একটা নতুন সংরূপ হিসেবে বাজারে এসেছিল, যার লেখক থাকতেন অনেকে। বারোয়ারি উপন্যাসে, সম্পাদকের ইচ্ছায় লেখকসমূহ লেখার জন্য নির্বাচন করে নেন এক বা একাধিক পরিচ্ছেদ; আখ্যানের রিলে রেসে পূর্ববর্তীর থেকে নিয়ে ব্যাটন চালান করেন পরবর্তীকে। গল্পের নির্মাতা বদলে যান কিন্তু গল্পের ও পঠনের গতি ব্যাহত হয় না। ব্যাহত যাতে না হয়, তা দেখবার কাজটাই সম্পাদকের। একইভাবে ‘বারোয়ারি গোয়েন্দা’র লেখকও কোনো নির্দিষ্ট একজন নন, বরং একটি লেখকগোষ্ঠী। তাঁরা সম্মিলিতভাবে ওই একটি গোয়েন্দা-চরিত্রটিকে নিয়ে লেখেন বিভিন্ন টেক্সট। বাংলা ক্রাইম-কাহিনিতে এলেমদার গোয়েন্দাদের অভাব নেই, তবে তাদের স্রষ্টারা নির্দিষ্ট। বাংলার প্রথম স্বীকৃত ‘বারোয়ারি গোয়েন্দা’— প্রতুল লাহিড়ী (Pratul Lahiri), যার আবির্ভাবটি হয়েছিল 'রোমাঞ্চ' পত্রিকার পাতায়। ১৯৩২ সালের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত ‘ইয়াংসু হোটেলের কাণ্ড’ প্রতুল আর তার সহকারী বিশুকে নিয়ে লেখা প্রথম গল্প। চিনে দস্যুদের সঙ্গে প্রতুল-বিশুর গুলি-বন্দুক-ছুরির অ্যাকশানে ভরপুর রোমহষর্ক অভিযানের গল্পটি লিখেছিলেন সেকালের বিখ্যাত গীতিকার প্রণব রায় (Pranab Roy)।

আধুনিক উৎপাদনের একটা উদাহরণ হিসেবে বারোয়ারি শিল্প, লেখক বা উৎপাদককে সৃষ্টির সমগ্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, পূর্ণের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়ে অংশবিশেষ নির্মাণের অধিকার দেয় এবং সবটার পেছনে থাকে বাজার নামের এক বিমূর্ত-বিস্ময়। বারোয়ারি গোয়েন্দার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, এক টেক্সটে আসা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অন্য টেক্সট চাপা দিয়ে দিচ্ছে, আবার সদর্থকভাবে এনে ফেলছে ভিন্নতর কিছুর সম্ভাবনা। ‘বারোয়ারি’ প্রতুলের ক্ষেত্রেও এমনভাবেই লেখকদের বহুস্বর প্রতুল-সমগ্রকে নির্মাণ করছে। প্রতুলের প্রতিটি টেক্সট, যেন এই প্রতুল-সমগ্রের এক-একটি পরিচ্ছেদ। প্রতুল লাহিড়ী, বারোয়ারি শামিয়ানায় থাকার জন্য ধারাবাহিক চরিত্র হয়েও সেরকম কোনো একরৈখিক বিবর্তনের বিষয় হতে পারেনি, বেশকিছু ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতাও লঙ্ঘিত হয়েছে।

যেমন— বাড়ি কলকাতাতে বলা হলেও বিভিন্ন লেখকের হাতে বাড়ির জায়গাটা নির্দিষ্ট থাকেনি। কখনো বর্মী দস্যুনেতা পুড়িয়ে দিয়েছে প্রতুলের বাড়িঘর, প্রতুল-বিশুকে উঠে যেতে হয়েছে হোটেলে। কিন্তু পরের গল্পের লেখকের কল্যাণে তারা একটি অবিকৃত বাড়ি ফিরে পেয়েছে।

পঠনকালে পাঠকের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে Suspension of disbelief, যা তাকে পদে পদে টেক্সটের বাস্তবতা সম্পর্কে, কার্য-কারণের লৌহশিকল সম্পর্কে প্রশ্ন করতে বাধা দেয়, নৈয়ায়িক যুক্তিদের ডেকে এনে পাঠের মজাটি মাটি করতে দেয় না। মনে রাখতে হবে, জনপ্রিয় সাহিত্য যেহেতু বিনোদনের মাত্রাতেই বিচার্য, বয়ানের এই ছোটখাটো গরমিল নিশ্চয়ই সেদিনের টিভিস্ক্রিন না-দেখা পাঠকের মনোযোগে ক্ষতিবৃদ্ধি করতে পারেনি। গল্পের গতিময়তার সামনে প্রতুলের ছোটখাটো ডিটেল তাই খুব বড়ো কোনো ইস্যু ছিল না।

প্রণব রায়, পাঁচুগোপাল মুখোপাধ্যায়, মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রলাল ধর, সুবোধ সেনগুপ্ত, সুনীল ধর, পরেশচন্দ্র বসু এবং আরো অনেক পরিচিত-অপরিচিত লেখক প্রায় কুড়ি বছর ধরে 'রোমাঞ্চ’র  নানা সংখ্যায় প্রতুলকে হাজির করছিলেন। যেখানে গোয়েন্দাগিরির ঢং, অপরাধী বা সমস্যার অভিনবত্বের পাশাপাশি, গোয়েন্দা-গল্পে পাঠকের মনে দাগ কাটতে ‘গোয়েন্দার চারিত্রিক বিশিষ্টতা’ খুব কাজের বলে প্রমাণিত হয়েছে বারবার, সেখানে একাধিক লেখকের হাতে পড়ে ‘বারোয়ারি’ প্রতুলের মধ্যে সেটা হয়তো যথেষ্ট দানা বাঁধেনি। নইলে, তার মধ্যে ক্ষমতা ছিল এমনকি কুড়ি-পঁচিশ বছর পরের দীপক চ্যাটার্জীকেও যোগ্য চ্যালেঞ্জ দেওয়ার। কারণ, শিবরামের ভাষায় ‘অজর’, ‘অমর’, ‘অকাট্য’ হার্ড-বয়েলড বাঙালি গোয়েন্দার একদম প্রথম ছাঁচ— বাংলার শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ প্রতুল লাহিড়ী। দীপকের মতই প্রতুলেরও দুশমনদের থাকত জাঁদরেল সব নাম আর বৈশিষ্ট্য। গোয়েন্দাগিরির ঢং পুরোটা না হলেও, খানিকটা একইরকম। বড়ো প্রকাশনীর ছাতার তলায় থাকা কৃষ্ণা, শিখা, দীপক চ্যাটার্জীরা পরবর্তীকালের পাঠকের কাছে যতটা পুনরাবিষ্কৃত, প্রতুল যেন ঠিক ততটাই বিস্মৃত। কিন্তু প্রতুল, আর সেই সূত্রে রোমাঞ্চের জনপ্রিয়তা সে-যুগে ছিল দুর্দান্ত। মনে রাখতে হবে, প্রতুল কিন্তু ফেলুদা-ব্যোমকেশ-কিরীটির আগের যুগে ‘বাংলার শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ’ও বটে! অন্তত, একাধিক টেক্সটে তার উপন্যাসের চরিত্ররা অনেকে এই পরিচয়েই প্রতুলকে প্রথম দেখায় চিনে ফেলছে। 

সাপ্তাহিক 'রোমাঞ্চ'র ছাঁচেই পরে বাজারে এসেছে আরো নানা ক্রাইম-সিরিজ আর পত্রিকা। ১৯৩৩ সালে 'রোমাঞ্চ'-এর দেখাদেখি আরেক বারোয়ারি গোয়েন্দাকে (তরুণ গুপ্ত) আমদানি করল 'রহস্যচক্র' সিরিজ, এবং ক্রমে আরো অনেকেই। কিন্তু প্রতুলের মতো দীর্ঘ পথ (১৯৩২-১৯৫২) তারা চলতে পারেনি। ১৯৫২ সালের পর সাপ্তাহিক 'রোমাঞ্চ' নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে 'মাসিক রোমাঞ্চ' হিসেবে। পত্রিকার দায়িত্ব ও পরিকল্পনায় ততদিনে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর সুযোগ্য পুত্র রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়। তিনি উপলব্ধি করলেন টার্গেট-রিডারদের পাঠরুচি বদলেছে, তাদের টানতে চাই নতুন গোয়েন্দা, নতুন ধরণের গোয়েন্দাগিরি। অতএব 'রোমাঞ্চ' পত্রিকার যে পরিসর ছিল 'বারোয়ারি গোয়েন্দা' প্রতুলের জন্যই সংরক্ষিত, তাতে এবার অন্যান্য গোয়েন্দাকেও জায়গা দিতে হল। প্রতুল তখনো ব্রাত্য হয়নি বটে, তাকে কেন্দ্রে রেখে 'প্রতুল লাহিড়ীর দপ্তর’ নামের একটি প্রায়-নিয়মিত বিভাগ 'মাসিক রোমাঞ্চ' নিয়ে আসে, যাতে পাঠকের জন্য দেওয়া থাকত বুদ্ধির ধাঁধা। 'হত্যাকারী কে?'— এই মোক্ষম সওয়ালটির কিনারায় প্রতুলের পাশাপাশি সেখানে পাঠকও সুযোগ পেতেন। কিন্তু মাসিক-পর্বে প্রতুলকে নিয়ে লেখা অধিকাংশ উপন্যাসই মৃত্যুঞ্জয়বাবুর আরেক পুত্র অমিত চট্টোপাধ্যায়ের, নাহলে সাপ্তাহিক-পর্বেরই পূর্বপ্রকাশিত লেখার পুনর্মুদ্রণ। সেহেতু তার ‘বারোয়ারিত্ব’ ততদিনে প্রায় ঘুচে গেছে বললে অত্যুক্তি হয় না। তাই সাপ্তাহিক পর্যায়ের 'রোমাঞ্চ'-কেই বাংলার প্রথম 'বারোয়ারি' গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ীর বিচরণক্ষেত্র বলে ভেবে নেওয়া যায়।

ছবি - সাপ্তাহিক রোমাঞ্চ'র প্রচ্ছদ। (সৌ: সুজিত কুণ্ডু)

Powered by Froala Editor

Latest News See More