বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অখ্যাত একটি গ্রাম চাংড়িপোতা। আর সেখান থেকেই কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পড়তে এসেছেন এক তরুণ। শান্ত দুটো চোখে ঝলক দিয়ে যাচ্ছে বুদ্ধি। ছোটো থেকে মামার কাছে মানুষ। আর মামাও যে সে মানুষ নন; দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক তিনি। সেই ছোট্ট থেকেই সাহিত্য, সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা তরুণটির। উপরন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কলেজ বলে কথা! যে মানুষটাকে জীবনের আদর্শ করেছেন, তাঁরই প্রতিষ্ঠানে পড়তে পেয়ে আরও যেন নিজেকে মেলে ধরলেন তিনি।

তবে সময়টাও ছিল একটু অন্যরকম। উনবিংশ শতক। ব্রিটিশরা গোটা দেশ অধিকার করে নিয়েছে। আর তার মধ্যেই শুরু হয়েছে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার। এই ধর্মের মতবাদ, আদর্শ, একেশ্বরবাদ অনেককেই আকৃষ্ট করল তখন। বিশেষ করে, অল্পবয়সী যুবারা দলে দলে যোগ দিতে শুরু করলেন এখানে। সনাতন ধর্মের কুসংস্কার, গোঁড়ামিকে আক্রমণ করতে লাগলেন। সংস্কৃত কলেজের ওই যুক্তিবাদী তরুণ, শিবনাথ শাস্ত্রীও এই দলে ভিড়লেন। আর ছেলে ব্রাহ্মসমাজে যাচ্ছে, এমন কথা শুনে তেড়েফুঁড়ে উঠলেন বাবা। তাঁরা রক্ষণশীল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ; এভাবে ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারেন! 

কিন্তু শিবনাথ যাকে বলে, নাছোড়বান্দা। ছোটো থেকে বাবার বদমেজাজ সহ্য করে এসেছেন তিনি। এবার তাঁর স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ করতে চান তিনি! শুরু হল বাবা-ছেলের যুদ্ধ। এমন যুদ্ধ তো সেই সময় কলকাতায় হরদম দেখা যেত। কিন্তু এখানে যে তরুণটির নাম শিবনাথ শাস্ত্রী! পরবর্তীকালে বাংলার ইতিহাসের খাতায় তাঁর নাম উঠে যাবে চিরকালের জন্য। যাই হোক, ছেলের যে কোনভাবে ‘মতি ফিরবে না’, সে কথা বুঝে গিয়েছিলেন বাবা হরানন্দ ভট্টাচার্য। যার অবশ্যম্ভাবী ফল, শিবনাথের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করা। রবং তারপরই বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া… 

ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথা এলে শিবনাথ শাস্ত্রীও আসবেন অবধারিতভাবে। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেই তিনি উঠে আসেন সারিতে। প্রথমে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেও, পরে সেই আকর্ষণ চলে যায় কেশবচন্দ্র সেনের দিকে। যুক্তি, চিন্তা আর প্রশ্নের মাধ্যমেই আসল ব্যাপারগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন তিনি। একটা সময় মদ্যপানের বিরোধিতা করে বের করেছিলেন আস্ত একটি মাসিক পত্রিকা ‘মদ না গরল’। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নানা সময় নানা আন্দোলন করেছেন। কেন একটি মেয়েকে নাবালিকা অবস্থাতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি। সেই বিবাহের বয়স যাতে ন্যুনতম ১৪ বছর হয়, তারই চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু যখন দেখলেন কেশবচন্দ্র সেন নিজেই তাঁর নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে দিলেন, তখনই সরে এলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৭৮ সালে তৈরি করলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। 

এ তো ছিল সমাজসংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী। পাঠক, এবার আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করাব অন্য একটি দিকে। তিনি কবি শিবনাথ। তখন স্কুলের ছাত্র তিনি। ক্লাসেরই একটি ছাত্রের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না বাকিদের। ধনী পরিবারের সন্তান; কাজেই তার দেমাকও তেমন। পড়াশোনাতেও মন ছিল না একেবারে। সেই ছেলেই একবার প্রথম হয়ে গেল! ব্যস, আর পায় কে! অহংকার যাকে বলে আকাশে পৌঁছে গিয়েছিল। আর সেই ছাত্রটিকে জব্দ করার জন্যই কিশোর শিবনাথ একটা ফন্দি আঁটলেন। নিজের মনেই লিখে ফেললেন একটি কবিতা; অবশ্যই ব্যঙ্গাত্মক। আর যায় কোথায়! শিবনাথের সেই একটা কবিতাতেই বোমা ফাটল ক্লাসঘরে। জীবনের প্রথম কবিতা ওইখানেই… 

তারপর থেকে মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’-এই প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর কবিতা। অবশ্য স্বনামে নয়; ছদ্মনামে। ‘শ্রীশ’ নামে ভরে উঠতে লাগল পত্রিকার পাতা। প্রায় সবই ব্যঙ্গাত্মক রচনা। কবিতার ছন্দের আড়ালে বসেই মেঘনাদের মতো সমাজকে দেখতে লাগলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ওই লেখাগুলো থেকেই তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ এবং সমাজ-সংস্কারের বিষয় চলে আসার ফলে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি। কবি শিবনাথ শাস্ত্রীকে আর সেভাবে দেখতেই পেল না বাংলা। 

আরও পড়ুন
চ্যালেঞ্জ জিততেই আস্ত ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ লিখে ফেলেছিলেন মাইকেল!

তথ্যসূত্র-
১) ‘ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের ফলে পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল শিবনাথ শাস্ত্রী’, সুরমিতা কাঞ্জিলাল, বঙ্গদর্শন
২) ‘শিবনাথ শাস্ত্রী: সংস্কারকের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক কবি’, পার্থসারথি পন্ডা, জিও বাংলা 

Powered by Froala Editor

More From Author See More