গরম জলে গলে যাবে মুহূর্তেই, অভিনব জৈব প্লাস্টিক তৈরি বাঙালি উদ্ভাবকের

“২০১৬ সাল। কর্মসূত্রে ওড়িশার এফসিআই-এ গিয়ে একটা বিষয় নজরে আসে। আমরা লক্ষ করি, এফসিআই গোডাউন থেকে বস্তা বস্তা প্লাস্টিক, বর্জ্য হিসাবে ফেলে দেওয়া হচ্ছে কোনোরকম প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই। এবং স্বাভাবিকভাবেই তা যেমন মাটিতে মিশছে, তেমনই জলবাহিত হয়ে মিশছে সমুদ্রেও। প্লাস্টিক দূষণের এই ভয়াবহ দৃশ্যই ভাবিয়ে তুলেছিল আমাদের। সেখান থেকেই শুরু হয় বিকল্প পথের সন্ধান।”

বলছিলেন তরুণ বাঙালি উদ্ভাবক সুদীপ্ত বসু। কলকাতার এই তরুণ প্রযুক্তিবিদ বিগত ১৭ বছর ধরে কাজ করে আসছেন সৌরশক্তি নিয়ে। তবে নিজের কর্মক্ষেত্রের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এবার তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা তৈরি করে ফেললেন অভিনব বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল জৈব প্লাস্টিক। এই গবেষণায় সুদীপ্তবাবুকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন ডঃ শৌর্য দাস, শুভব্রত গুহ বর্মন, সঞ্জয় মণ্ডল, ডোনা মণ্ডল, দেব মিত্র, পিনাকী গুহ।

স্বাভাবিক পরিবেশে মাটিতে ফেলে রাখলে মাত্র ১৮০ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিয়োজিত হবে এই প্লাস্টিক। পাশাপাশি গরম জলে চুবিয়ে রাখা হলে মুহূর্তের মধ্যেই গলে যাবে এই বিশেষ যৌগটি। আর সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সেই মিশ্রণ সম্পূর্ণ ভোজ্য! বিগত তিন বছর এই গবেষণার জন্য অক্লান্তভাবেই পরিশ্রম করেছেন সুদীপ্ত। উৎপাদনের প্রযুক্তি এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় অধ্যায়নের জন্য কখনও মুম্বাই ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কখনও আবার গুয়াহাটি আইআইটিতে ছুটেছেন বেহালার বাসিন্দা। তারপর নিজের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সেই প্রযুক্তিকে পরিণত করেছেন আরও।

আজ থেকে প্রায় দুই-আড়াই দশক আগে থেকেই বায়োডিগ্রেডবল প্লাস্টিক নিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক গবেষণা। বিগত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতেও উৎপাদিত হয়ে আসছে পচনশীল প্লাস্টিক। তবে বাংলায় জৈব প্লাস্টিকের উৎপাদন এই প্রথম। চারিত্রিক দিক থেকে তার গঠনেও রয়েছে অভিনবত্ব। সুদীপ্তবাবু জানালেন, “মূলত কর্নস্টার্চ বা ভুট্টা দিয়েই তৈরি হয় এই ধরনের প্লাস্টিক। তাছাড়া আখ, সাবুদানা, সোয়াবিনও ব্যবহৃত হয়। তবে আমরাই প্রথম আলু এবং এডিবল অয়েল ব্যবহার করেছি।” প্রশ্ন থেকে যায়, নতুন পদ্ধতিতে তৈরি এই জৈব প্লাস্টিকের বিশেষত্ব কী? 

আরও পড়ুন
৩০ বছরের মধ্যে মরুভূমিতে পরিণত হবে সেরাডো, সতর্কতা বিজ্ঞানীদের

প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সুদীপ্তবাবু তুলে আনলেন অন্য একটি প্রসঙ্গ, “বর্তমানে ভারতে যে জৈব প্লাস্টিক পাওয়া যায়, সেগুলির মূল্য প্রতি কেজি প্রায় ৯০০ টাকা। অন্যদিকে সাধারণ পেট্রোকার্বনজাত প্লাস্টিকের দাম সেখানে ১৫০ টাকার কাছাকাছি। ফলত, দামের তারতম্যের জন্যেই এই প্লাস্টিক ব্যবহারে অনীহা লক্ষ করা যায় সাধারণের মধ্যে। আমরা সেই খরচটাই কমিয়ে এনেছি দুই-তৃতীয়াংশে। প্রোটোটাইপ তৈরি করতে আমাদের খরচ হয়েছে মাত্র ৬০০ টাকা। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে, তা আরও কম খরচে তৈরি করা যাবে।” দ্রুত বিয়োজনের পাশাপাশি উৎপাদন মূল্যকেও অন্যতম ইতিবাচক দিক হিসাবেই মনে করছেন তিনি।

আরও পড়ুন
সূর্যালোকেই বিয়োজন প্লাস্টিকের, যুগান্তকারী আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের

আপাতত, দক্ষিণ ভারতের একটি প্ল্যান্ট থেকেই বিশেষভাবে তৈরি করানো হচ্ছে এই প্লাস্টিক। ইতিমধ্যে স্বীকৃতিও মিলেছে সরকারের তরফ থেকে। জানা গেল, স্থানীয় বিক্রেতাদের বিনামূল্যে এই প্লাস্টিক প্রদান করেছেন বাংলার তরুণ উদ্ভাবকরা। উদ্দেশ্য, প্লাস্টিকের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ। আশাপ্রদ ফলাফল মিললে বাংলাতেই আগামীদিনে জৈব প্লাস্টিক উৎপাদনের প্ল্যান্ট তৈরির কথাও ভাবছেন তাঁরা। ভরসা দিচ্ছেন,ভবিষ্যতের দূষণমুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার। সুদীপ্তবাবুর বিশ্বাস, পরিবেশকে সুস্থ রাখলে মজবুত হবে দেশের অর্থনীতিও। তরুণ বাঙালি উদ্ভাবকের এই কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই একেবারেই…

আরও পড়ুন
কতটা লবণ সইতে পারে ম্যানগ্রোভ? রহস্যভেদ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের

Powered by Froala Editor