ফিরিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ ক্লাবের ডাক, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটেও তুখোড় ছিলেন চুণী

অবিভক্ত বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে সুবিমল গোস্বামী নামখানা চলনসই হলেও, এখন ওই নাম বললে আর কেউ ঠাউর করে উঠতে পারবেন না। অবশ্যি খাস কলকাতাতেও হয়তো ওই নামে কাউকে চিনে ওঠা মুশকিল অনেকের কাছে। কিন্তু যে নামে ডাকলে একবাক্যে সকলের মনে ধরে যায়, তাই যেন ভারতীয় ক্রীড়ার রত্নভাণ্ডারে সবচেয়ে দামি রত্নখানা - আমাদের চুণী, চুণী গোস্বামী। ভারতীয় ফুটবলের প্রথম আদি ও অকৃত্রিম পোস্টারবয় চুণী গোস্বামী।

বাবা-মায়ের দেওয়া সুবিমলকে চুণী হয়ে উঠতে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি যদিও। নিজেকে ভারতীয় ক্রীড়ার উন্মুক্ত মঞ্চে মেলে ধরেছিলেন চুণী।

গোষ্ঠপাল সরণী বেয়ে তখন যেন অঘোষিত বিপ্লব৷ ব্রিটিশরাজের বিপক্ষে হাওয়া সারা কলকাতা জুড়ে, ফুটবলের মক্কায় সে ঢেউ এসে পড়ে মোহনবাগানেও। এমন একটা সময়েই ধূমকেতুর মতো চুণী এসে পড়েন, কিন্তু চুণী গোস্বামীর মোহনবাগানে আসার গল্প যেন আরও রোমাঞ্চকর। ১৯৪৬ সালে চুণী প্রথমবার পা রাখেন ক্লাবে। ৯ বছর বয়স থেকেই ইনসাইড-লেফট ফরোয়ার্ডে খেলতে থাকেন সবুজ মেরুন জার্সিতে। উইথ দা বল বুলেটের মতো গতি তাঁকে নজরে এনেছিল ক্লাবকর্তাদের। কিন্তু মাত্র ১৬ বছরেই যে সিনিয়ার দলে প্রথম ম্যাচ খেলা হয়ে যাবে, তা হয়তো দূর কল্পনাতেও ভাবেননি কেউ। ১৯৫৪ সাল। গঙ্গাপাড়ের ক্লাবের দুই দুঁদে স্ট্রাইকার রুণু গুহঠাকুরতা আর আবদুস সাট্টারের অভাব যেন বেশ প্রকটভাবে বোঝা যাচ্ছিল দলের খেলায়। এই সময়ে একদিন চুণী ম্যাচের বেশ কিছুক্ষণ আগে ঢোকেন ড্রেসিংরুমে একজন যুব খেলোয়াড় হিসেবে। কোচ বলাইদাস চাটুজ্জের কথায় লুকিয়ে লুকিয়ে গায়ে চাপিয়ে নেন সবুজ-মেরুন জার্সি। কিছুক্ষণ পরেই জানাজানি হয়ে যায় এই ঘটনা। মোহনবাগান ক্লাবের সে সময়ে এক অন্ধবিশ্বাস ছিল। তা হল, যদি ম্যাচের দিন ড্রেসিংরুমে কোনো খেলোয়াড় জার্সি পরে নেয়, তাহলে সে ভবিষ্যতের তারকা হবেই এবং সেই ম্যাচে তাকে খেলাতে হবে!

কোচের প্ল্যানিং-এ না থাকলেও, অদ্ভুতভাবে দলে অভিষেক হয়ে গেল চুণীর। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই পেয়ে গেলেন নিজের প্রিয় লেফট ইনসাইড স্ট্রাইকার পজিশন। সেই শুরু!

নিজের পছন্দের ক্লাব আর পছন্দের লেফট ইনসাইডেই নিজের কেরিয়ার শেষ করলেন চুণী। এমন আশ্চর্য প্রতিভা কি আর দেখা গেছে বাংলা ফুটবলে? বিতর্ক থাকবে!

মোহনবাগানের ছেলে হিসেবে যদি প্রথম সারিতে উঠে আসে সুব্রত-শৈলেনের নাম, তবে চুণী গোস্বামী নির্দ্বিধায় এই তালিকায় শীর্ষ স্থানটি দাবি করেন। ১৯৬০ সালে কেরিয়ারের তুঙ্গে থাকা চুণীকে পেতে মরিয়া হয় ইস্টবেঙ্গল। সে সময়ে ইস্টবেঙ্গল মসনদে কর্তা জে সি গুহ। চুণী গোস্বামী প্রাথমিকভাবে রাজি না হলে তিনি সেই সময়ে কলকাতার সবচেয়ে দামি ফিয়াট গাড়িটি অফার করে বসেন তাঁকে। এই প্রলোভন অস্বীকারের দৃঢ়তা সে সময়ে হয়তো খুব হাতে গোনা মানুষেরই থাকতে পারে, চুণী এই প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে হেসে নিজের অটল মতাদর্শ মেলে ধরেছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তার সামনে। তবে বাংলার প্রতি টান চুণী গোস্বামীর ছিল প্রবল, কলকাতায় আসার পর থেকেই ক্রিকেট আর ফুটবল দুই ক্ষেত্রেই বাংলার প্রতিনিধিত্বের বিরল কৃতিত্ব তাঁর দখলে। ১৯৫৫ সন্তোষ ট্রফিতে প্রথমবার বাংলার হয়ে মাঠে নামেন তিনি। আর ফাইনালে কিংবদন্তি পিকে ব্যানার্জিকে জয়সূচক গোলের অ্যাসিস্টও এল তাঁর পা থেকেই। এরপর ১৯৫৮ সালের টোকিও এশিয়ান গেমসের পর থেকে নিয়মিত জাতীয় দলের জার্সি ওঠে তাঁর গায়ে। ১৯৬২ সালে তাঁর কাঁধে ভর করেই এল এশিয়ান গেমসে সোনা, ভারতীয় ক্রীড়ার সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়।

তবে চুণী গোস্বামীর সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়তো লুকিয়ে আছে আরও একমজাদার গল্পের ভিতর৷ ১৯৬০-৬১ মরশুমে নিজের কেরিয়ারের সর্বোত্তম পর্যায়ে ফুটবল খেলছেন চুণী। বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পারের থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছাল খাস কলকাতায়। খামের ওপর কালো হরফে লেখা সুবিমল গোস্বামী, চিঠির প্রেরক কিংবদন্তি বিল নিকোলসন। সেই বছরই প্রথম ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হয় টটেনহ্যাম। ইংল্যান্ডের ক্লাবটির তরফে চুণী গোস্বামীকে প্রস্তাব জানানো হয়, টটেনহ্যামের সঙ্গে একটি ট্রেনযাত্রার মাধ্যমে ইংল্যান্ডে আসার জন্য। চুণী তখন মোহনবাগানের রত্ন হয়ে বিরাজ করছেন। পরবর্তীকালে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ব্রিটিশ ফুটবল সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তিনি ঐ চিঠির মর্ম সেদিন বোঝেননি। ভেবেছিলেন হয়তো মোহনবাগানের চেয়ে বড় ক্লাব নয় ব্রিটিশ ওই ক্লাব। কিছুদিন আগে এক সম্মেলনে কথাটা বলতে বলতে যেন নিজের অজান্তেই চোখে আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছিল কিংবদন্তির।

এখানেই তো চুণী গোস্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব, ফুটবলের পর ক্রিকেটের ইনিংস শুরু এবং তাতেও বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি ও দলীপ ট্রফিতে খেলা, অধিনায়কত্ব লাভ! ১৯৬৯ আর ১৯৭২ সালে, রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে ওঠে বাংলা। দ্বিতীয়বার অধিনায়ক ছিলেন চুণীই। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর রেকর্ডও নেহাৎ খারাপ নয়। ৪৬টি ম্যাচ খেলে করেছেন ১৫৯২ রান। উইকেট ৪৭টি। প্রবীণরা এখনও মনে করতে আরেন ১৯৬৯-এর রঞ্জির সেই ফাইনাল। দু-ইনিংসে ৯৬ এবং ৮৪ রান করেছিলেন চুণী। ফার্স্ট ক্লাস ফুটবল ও ক্রিকেটে একই সঙ্গে খেলেছেন - সারা বিশ্বে চুণী গোস্বামীর সঙ্গে তুলনীয় মাত্র একজনই, ডেনিস কম্পটন। আরও অবাক-করা তথ্য, কলকাতার সাউথ ক্লাবে লন টেনিসও খেলেছেন তিনি একসময়।

এমন আশ্চর্য প্রতিভা আর হয়তো আসেনি বাংলায়, আসবেও না। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের ছোট্ট সুবিমল গোস্বামীর বাবা-মা ভালবেসে ডাকনাম রেখেছিলেন চুণী, সেই চুণী যা ভারতের রত্নভাণ্ডারের সবচেয়ে দামী রত্ন হয়ে থেকে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে…