২৮ ঘণ্টায় ২১৬টি ছবি, ১৭ ঘণ্টায় ২৯টি মূর্তি; একের পর এক বিশ্বরেকর্ড বঙ্গতনয়ার

“শিল্প তো প্রাণের তাগিদে সৃষ্টি হয়। তাকে ধরাবাঁধা শিক্ষার মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় না। শিল্পের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়াটাই আসল কথা।” বলছিলেন শিল্পী রমিতা ভাদুড়ী। একের পর এক রেকর্ড তৈরি করে যিনি সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছেন। কখনও ২৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এঁকেছেন ২১৩টি ছবি। কখনও বা ১৭ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করেছেন ২৯টি মূর্তি। আজ অবধি সারা পৃথিবীতে এত দ্রুত কাজ করার রেকর্ড কোনো শিল্পীরই নেই। কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন তিনি? শিল্পীর কথায়, “আমি যখন যে কাজটা করি, তার মধ্যেই ডুবে থাকি। ২৮ ঘণ্টা কেন, আমি আরও বেশি সময় ধরে একটানা ছবি এঁকে যেতে পারি। তখন মূর্তি তৈরির কথা খেয়াল থাকে না। আবার মূর্তি তৈরি করতে বসলে ছবি আঁকার কথা খেয়াল থাকে না। একইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গানও গেয়ে যেতে পারি।”

শুধুই ছবি বা মূর্তি তৈরিই তো নয়। গানের জগতেও রমিতা ভাদুড়ী এক অনন্য নাম। ২০১৩ সালে জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর গান জায়গা করে নিয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড টপ ২০’ তালিকায়। রমিতা বলছিলেন, “এই সবই আসলে আমার রক্তের মধ্যে আছে। ছোট থেকে বড়ো হয়ে ওঠাই তো শিল্পের মধ্যে।” বাবা দরবার ভাদুড়ী ছিলেন গণনাট্য সংঘের একজন প্রতিভাবান সুরকার। ঋত্বিক ঘটকের শেষ নাটক ‘জ্বালা’-তেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন দরবার ভাদুড়ী। মা নমিতা ভাদুড়ীও সারা জীবন কাটিয়েছেন সাহিত্য সাধনায়। খুব ছোটো থেকেই ব্রজেন বিশ্বাসের মতো তবলিয়ার সংস্পর্শে এসেছেন রমিতা। এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই একটু একটু করে তৈরি হয়েছে তাঁর শিল্পীসত্তা।

তবে শিল্পের জগতে জায়গা করে নেওয়ার পথটা খুব সুগম ছিল না কোনোদিনই। সংসারের অভাব অনটন তো ছিলই। রমিতা বলছিলেন, “পাথর কেটে মূর্তি তৈরির ইচ্ছা ছিল বরাবরই। কিন্তু পাথর পাব কোথায়? একদিন বাঁকুড়া থেকে এক ব্যক্তি অনেকগুলো পাথর রেখে গেলেন বাড়ির সামনে। সেসব ব্যাসল্ট ধরণের পাথর। তাকে খোদাই করতে রীতিমতো গায়ের জোর দরকার। তবে পুরনো স্ক্রু-ড্রাইভার আর হাতুড়ি নিয়ে তাই ভাঙতে বসে গেলাম। আর দেখতে দেখতে মূর্তি রূপও পেয়ে গেল।” এইভাবে মূর্তি তৈরির খরচ কমাতে গিয়েই আবিষ্কার করে ফেললেন আরও একটি পদ্ধতি। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার জন্য ব্যবহৃত সাদা চোখ কুঁদেই তৈরি করে ফেললেন একের পর এক মূর্তি। আজ সারা পৃথিবীতে ‘চক স্কাল্পচার’ ঘরানার অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে স্বীকৃত তিনি।

আরও পড়ুন
ছকভাঙা তথ্যচিত্রে মহারাষ্ট্রের লোককথা, আন্তর্জাতিক সম্মাননা বাঙালি পরিচালকের

রমিতার কথায়, “আমার শিল্প তো প্রথাগত শিক্ষা থেকে তৈরি নয়। তৈরি হয় জীবনের উপলব্ধি থেকে।” আর তাই সেখানে একটা বড়ো অংশ হিসাবে থাকে সমাজবোধ। তিনি বলেন, “আমি রাজনীতি করি না। কিন্তু আমার শিল্পের ভিতর দিয়েই সমাজকে দেখি।” তাই তাঁর ছবি কথা বলেছে ২৬/১১ মুম্বাই বিষ্ফোরণ নিয়েও। সেই সময় তাঁর চক স্কাল্পচার প্রদর্শিত হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সাফল্যের শুরু সেখান থেকেই। আর তারপর, ২০১১ সালে সেই প্রদর্শনীর জন্যই তাঁর নাম জায়গা পেল পিস হিস্ট্রি ডেটাবেসে। চক স্কাল্পচারের স্বীকৃতি হিসাবে নাম উঠেছে ‘ইন্দো-চায়না রেকর্ড বুক’-এও। ২০১৮ সালে ২৮ ঘণ্টায় ২১৬টি ছবি এঁকে নাম তুললেন ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ডস’-এ। এই একই তালিকায় ২০১৯ সালে রেকর্ড তৈরি করলেন ১৭ ঘণ্টায় ২৯টি মূর্তি তৈরি করে। নাম তুলেছেন ‘ওয়াও ইন্ডিয়া রেকর্ডস’ বা ‘টাইম ওম্যান হিরোস’ তালিকাতেও। আর এবছর সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে পরিচালকের জীবন নিয়ে আঁকা ৪২টি ছবির জন্য স্বীকৃতি পেতে চলেছেন ‘গ্লোবাল রেকর্ড অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ থেকে।

আরও পড়ুন
১৪ দেশের ৯৫ জন শিল্পীর সংহতি, সুরে-সুরে নতুন সময়ের স্বপ্ন বুনল কিউএসওয়াইএন

জীবনে এত সম্মানের পরেও নির্লিপ্ত থাকতে পারেন রমিতা। তিনি বলেন, “আমি তো সম্মান পাওয়ার জন্য শিল্পের জগতে আসিনি।” তবে একেবারে যে আনন্দিত নন, তা নয়। “মা বলতেন, জীবনে এমন কিছু যেন করতে পারি যাতে সবাই আলাদা করে চিনতে পারে। মায়ের সেই কথা রাখতে পেরেছি।” তবে শিল্পের তাগিদেই জড়িয়ে থাকা শিল্পের সঙ্গে। তাই আগামী দিনে আরও আরও সাফল্যের কোনো প্রত্যাশাই নেই তাঁর। স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করলে হাসতে হাসতে বলেন, “স্বপ্ন তো অনেক কিছুই। ছবিতে, ভাস্কর্যে রেকর্ড তৈরি করেছি। ইচ্ছে হয় গানের জগতে তৈরি হওয়া রেকর্ডও ভেঙে দিই। সুযোগ পেলে নিশ্চই সেই চেষ্টাও করব।” রমিতা বলতে থাকেন, “তবে একটা জিনিস শিখেছি, পৃথিবীতে এসেছি যখন তখন যা পারি তা করে যেতে হবে। তাই সম্মান পাই বা না পাই, আমার সৃষ্টির মধ্যেই আমি ডুবে থাকব।” এই ডুবে থাকার মধ্যে দিয়েই তো শিল্পের জন্ম হয় বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

আরও পড়ুন
শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, স্বৈরাচারের প্রত্যক্ষ উদাহরণ মায়ানমারে

Powered by Froala Editor

More From Author See More