পরিবেশ সুরক্ষা আইনের খসড়ায় ব্রাত্য বাংলা-সহ একাধিক ভাষা; প্রশ্ন প্রণয়নের স্বার্থ নিয়েও

যে ধরণের কাজকর্মের ফলে প্রকৃতির উপর ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারে এবং বাড়তে পারে দূষণের পরিমাণ, তা নিয়ন্ত্রণ করতেই পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৮৬-এর অধীনে প্রথমবার ভারতে ইআইএ চালু করার কথা বলা হয়েছিল। তার আগেই ১৯৮৪ সালে ঘটে গেছে ভয়াবহ ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। বস্তুত সেই ট্র্যাজেডির প্রেক্ষিতেই তত্কালীন সরকার ১৯৮৬ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর করতে তৎপর হয়েছিল। এই আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই সমস্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য ‘ইআইএ’ প্রক্রিয়াটি হওয়া প্রয়োজন।

এই আইন অনুযায়ী কোনো বড় প্রকল্প স্থাপনের আগে সেখানকার পরিবেশের উপর তার কী প্রভাব পড়বে, তার জরিপ এবং সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এই মূল্যায়ন পদ্ধতির একটি অঙ্গ হল সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের নিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে গণশুনানির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বারবার বিতর্কের মুখে পড়েছে পরিবেশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটিই বদলে দেওয়ার চেষ্টা এবং সেই প্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের রুখে দাঁড়ানোর পরেও তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দেওয়ার উদ্ধত মনোভাব।

শিল্প স্থাপনের আগে পরিবেশের উপর তার প্রভাব এড়িয়ে যাবার জন্য এই পুরোনো আইনটি সংশোধনের চেষ্টা করেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন বন ও পরিবেশমন্ত্রক। স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে গণশুনানি এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিকে এড়িয়ে যেতে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের এই প্রচেষ্টা একান্তভাবেই বড় শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা ভেবে, এমনই অভিযোগ তুলেছেন সমাজবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদরা। এইভাবে যদি পরিবেশের উপর প্রভাবের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে কর্পোরেট সংস্থাগুলি এদেশের জল-জমি-জঙ্গল নির্বিচারে লুঠ করে চলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। ভয়টা থেকে যাচ্ছে আরও একটা জায়গায়। পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই এই সমস্ত অঞ্চলের আদিবাসী মানুষের বিকল্প রুটি-রুজির সন্ধান কী হবে, সেই সম্বন্ধে এখনো কোনও বিশদ ভাবনাচিন্তার প্রকাশ দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে।

নতুন আইনের খসড়ায় পরিবেশের উপর প্রভাবের মূল্যায়নের বাইরে রাখা হয়েছে মাঝারি থেকে ছোট নির্মাণশিল্পগুলিকে। পরিবেশ কর্মীদের একাংশ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, খসড়ায় শুধুমাত্র বড় ইমারত এবং নির্মাণ শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে আদতে কাজের-কাজ খুব একটা বেশি কিছু হবে না। তার কারণ, কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই সহ দেশের বেশিরভাগ শহরেই বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হল নির্মাণশিল্প।

এই সময়েই এই খসড়া বিলটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের মধ্যেই গত ৩০শে জুন দিল্লি হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছিল আগামী ১০ দিনের মধ্যে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে যে সকল ভাষার উল্লেখ করা আছে অন্তত সেই সমস্ত ভাষায় এই খসড়া নথিটি অনুবাদ করে দিতে হবে। দেশের সমস্ত অঞ্চলে খসড়াটির মূল বক্তব্য পরিষ্কার করতেই এই রায় দিয়েছিল আদালত। এর আগে বিতর্কের মুখে ড্যামেজ কন্ট্রোলের কায়দায় আগামী ১১ই আগস্ট পর্যন্ত নথিটি নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে জানানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টের আদেশের পরেও নথিটির অনুবাদ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না শোনা যাওয়ায়, অবশেষে রাইট টু ইনফরমেশন বা তথ্য জানার অধিকারের দ্বারস্থ হতে হয় পরিবেশকর্মীদের। এবং তখনই বিতর্কিত অধ্যায়ের পরবর্তী অংশের সূচনা।

আরটিআই-এর জবাবে মন্ত্রকের তরফে জানানো হয় যে, এখনও অবধি স্বীকৃত বাইশটি ভাষার মধ্যে কেবল মাত্র তিনটি ভাষাতেই অনুবাদ সম্ভব হয়েছে। মাঝে এত দিন কেটে গেলেও কেন শুধুমাত্র মারাঠি, নেপালি এবং ওড়িয়া ভাষাতে এই অনুবাদের কাজটি সম্পূর্ণ হল, কেন বঞ্চিত থেকে গেল সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, স্বাভাবিকভাবেই এরকম একাধিক প্রশ্ন উঠেছে সেই নিয়ে। উন্নয়ন দরকার অবশ্যই। দরকার হাইওয়ে কিংবা জলবিদ্যুতের মতো প্রকল্পগুলিও। কিন্তু যে ভাবে এই আইনে কোনও আলোচনার অবকাশ না রেখেই এবং পরিবেশের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই শিল্প স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, আপত্তি উঠেছে সেই জায়গাটি নিয়েই।

আরও পড়ুন
ব্যাটারি কারখানার দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই, ১১ বছর পর জয় কেনিয়ার পরিবেশ কর্মীর

মানুষ যদি ভালো করে বাঁচতে নাই পারে, তাহলে জলবিদ্যুৎ বা রাস্তার প্রয়োজনটা আদতে কার কাছে থাকবে, এই প্রশ্নে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন পরিবেশকর্মীরা। বহু ভাষাভাষীর দেশে সেই সম্মিলিত প্রতিবাদকে টুঁটি চেপে ধরতেই কি কেন্দ্রীয় সরকারের এমন পদক্ষেপ? এছাড়াও মাতৃভাষায় সঠিক তথ্যের অধিকার যখন দেশবাসীদের ফান্ডামেন্টাল বা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পরিগণিত হচ্ছে, তখন আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই নথির ভাষান্তর নিয়ে ছেলেখেলা করা যে আদতে সরকারের চরম দাম্ভিক এবং ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাবটিই আরো একবার নগ্ন করে দিল, সেকথাই পরিষ্কার হয়ে গেল নাকি আরো একবার?

সাম্প্রতিক অতীতে বারংবারই দেখা গেছে, আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়ার একটা কুটিল খেলা মদত পেয়ে চলেছে ক্রমাগতই। ক্রমশই উগ্র থেকে উগ্রতর হয়েছে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন। দিল্লির উচ্চ আদালতের নির্দেশ হেলায় উড়িয়ে দিয়ে সেই আগ্রাসনের ধ্বজাই বজায় রাখা হল, এমন আশঙ্কার মেঘও কিন্তু এখন প্রবল ভাবেই ঘনিয়ে এসেছে শুধুমাত্র পরিবেশ নয়, আঞ্চলিক ভাষা এবং সংস্কৃতির আকাশেও।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
পরিবেশের নিয়ত ক্ষতি করে চলেছে এই ভাগাড়, আদালতের জরিমানার মুখে রাজ্য

Powered by Froala Editor

More From Author See More