ছাত্রছাত্রীদের ‘ভূতবিদ্যা’র পাঠ দিতে চেয়েও ব্যর্থ বিএইচইউ; কী ছিল এই কোর্সে?

পড়াশোনার বিষয় হল, ‘ভূতবিদ্যা’! আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের আবেদনও করতে বলা হয়েছিল যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে এমন খবর সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল সকলকে। ৬ মাসের সার্টিফিকেট কোর্সে ভূত নিয়ে পড়াশোনা? মানেটা কি? আশ্চর্যের আরও কারণ ছিল, এমন ধরণের কোর্সটি চালু করেছিল দেশের অন্যতম নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইচিউ)। তবে এমন চমকদার বিষয় হলেও, শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হতে চলেছে এবার এই কোর্সটি।

সারা দেশে তো বটেই, হয়তো সারা পৃথিবীতেই এরকম একটি বিষয় নিয়ে প্রথম পড়াশোনা চালু হতে চলছিল। প্রাথমিক ভাবে উৎসাহও দেখা গিয়েছিল দেশ-বিদেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। তবে নতুন শিক্ষাবর্ষ পড়তে না পড়তেই শুরু হয়ে যায় করোনার প্রকোপ। ফলত, দেশ জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘আনলক’ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি মিলিত সিদ্ধান্ত নেন যে, অত্যন্ত কম আবেদনের প্রেক্ষিতে আপাতত আর এগোনো হচ্ছে না কোর্সটিকে নিয়ে। এর সঙ্গে আরও চারটি বিষয়ের কোর্সও স্থগিত করার খবর জানানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে।

কিন্তু যা নিয়ে এত বিতর্ক বা আলোচনা, সেই ‘ভূতবিদ্যা’ বা ‘সায়েন্স অফ প্যারানর্মাল’ জিনিসটা আসলেই কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছিল, ‘ভূতবিদ্যা’ হল এক প্রকার ‘সাইকোথেরাপি’। বিশ্ববিদ্যালয়ের আযুর্বেদ ফ্যাকাল্টির ডিন যামিনী ত্রিপাঠীর মতে, ভূতবিদ্যা হল ভারতীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ শিক্ষার মূল আটটি শাখার অন্যতম৷ যা মূলত ‘সাইকোসোমাটিক ডিস-অর্ডার’ বা মনোবিকার জনিত রোগের অজানা কারণ নির্ণয় করে মানসিক রোগের চিকিৎসা করে থাকে। এই সাইকোসোমাটিক ডিস-অর্ডার এবং অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থার অজানা কারণকেই ‘ভূতে ধরা’ বা ‘ভূত দেখা’ বলে মনে করে নেওয়া হয়। তাই এর থেকে কেমন করে রেহাই পাওয়া যায়, সেই বিষয়ে চর্চার জন্যই চালু হতে চলেছিল এই কোর্স, যা আঙ্গিকে অভিনব ছিল অবশ্যই!

তবে এই সার্টিফিকেট কোর্সটি সকলের জন্য নয়, বরং ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীরাই একমাত্র আবেদন করতে পারতেন এখানে। অস্বাভাবিক কারণে মানসিক রোগ এবং তার প্রকৃত অবস্থার চিকিত্সার জন্য এমন একটি বিষয়ে পড়াশোনা প্রয়োজনীয় ছিল বলে জানানো হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে। কারণ বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলেই এখনও মানসিক রোগের জন্য অতিপ্রাকৃতাকে দায়ী করা হয়। ফলে তার চিকিৎসার জন্য ডাকা হয় ডাক্তার নয়, বরং ওঝা বা গুনিনকে। 

সেন্টার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিনের থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্রও পাওয়া গিয়েছিল কোর্সটি চালু করার বিষয়ে। তৈরি হয়ে গিয়েছিল তিনটি নতুন ইউনিটও। গত জুলাই থেকেই কোর্সটি শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তারপরেই। যদিও ততদিনের মধ্যে এই বিষয়ে পড়াশোনার জন্য আবেদনও করে দিয়েছিলেন ১১ জন।

ভবিষ্যতে কোর্সটি আবার চালু হবে কিনা, সেই প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে কিছুই বলে পারেনি কর্তৃপক্ষ। যদিও আগ্রহীরা উৎসাহ হারাচ্ছেন না এখনই। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন জানিয়েছেন, ‘ভূত’ সম্পর্কিত অজানা বহুদিক এবং সাইকোসোমাটিক ডিসঅর্ডার থেকে মুক্তির জন্য বর্তমানে আয়ুর্বেদিক সমাধান অসাধারণ একটি উপায়। এবং এখানেই জাগছে খটকা। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা তাহলে কেন পৌঁছতে পারল না এখানে? নাকি গলদ প্রতিষ্ঠানগত ভাবেই?

আরও পড়ুন
ধোনির ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি; ক্রিকেট কি এই শিক্ষাই দিচ্ছে আমাদের?

২০১৬ সালে ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ এন্ড নিউরোসায়েন্স (নিমহানস)-এর এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ১৪% মানুষ নানা ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পরিসংখ্যান দিয়ে জানায় যে, প্রায় ২০% ভারতীয় জীবনের কোন না কোন সময়ে অবসন্নতায় ভুগে থাকেন। কিন্তু ১৩০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসক বা মনোবিদের সংখ্যা চার হাজার জনেরও কম, যা চোখে পড়ার মতোই। মানসিক রোগীদের সামাজিক ভাবে হেয় করার প্রবণতা এখনও বর্তমান।  তার ফলে অনেকেই যেতে চান না মনোবিদদের কাছে। তাই এই ব্যাপারে সব চিকিৎসকদেরই শিক্ষিত করার পরিকল্পনা করেছিল বিএইচিউ কর্তৃপক্ষ। তবে প্রশ্নও উঠেছিল এই পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়েছিলেন যে, মানসিক চিকিৎসার জন্য ঠিকঠাক রিহ্যাব এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া থাকা দরকার। নইলে চিকিৎসা পদ্ধতি হাতুড়ে ডাক্তারদের থেকে আলাদা কিছুই হবে না। কোর্সটির এই ধরণের নাম পছন্দ করাকেও ‘রিগ্রেসিভ’ বা ‘পিছিয়ে পড়া’ মানসিকতার বলে উল্লেখ করেছিলেন অনেকেই।

সুতরাং, দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার হালটা ঠিক কী, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যায় এই পরিস্থিতি। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে অবশ্যই। কিন্তু তার জন্য ‘ভৌতিক’ কার্যকলাপ বা ‘ভূত’দের সামনে রেখে কতটা কাজের কাজ হত, সেটা অবশ্যই বিতর্কযোগ্য। এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে আরও একটু প্রাপ্তমনস্কতা কি আশা করা যায় না?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার উত্তরপ্রদেশে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আড়ালে কি কণ্ঠরোধের চেষ্টা?

Powered by Froala Editor

More From Author See More