বায়ার্নের টিমগেমের কাছে পর্যুদস্ত বার্সেলোনা; স্ট্র্যাটেজি এবং মেসি-নির্ভরতাই ডেকে আনল বিপদ

কোয়ার্টার ফাইনালের ফিক্সচারই যেন আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছিল, এ-বছর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ফাইনালের আগে আরও একটা ফাইনাল দেখবে বিশ্ববাসী। বার্সেলোনা বনাম বায়ার্ন মিউনিখ। ফুটবলপ্রেমীদের প্রত্যাশা ছিল তুল্যমূল্য একটি ম্যাচ পরখ করার। তবে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের পার্ফরমেন্সের পরে কোয়ার্টার ফাইনালে খানিকটা নিষ্প্রভ হয়েই ট্যুর্নামেন্ট ছাড়ল স্প্যানিশ জায়েন্ট। ম্যাচের ফলাফল ৮-২।

বেশ কিছুদিন ধরেই বার্সেলোনার ড্রেসিংরুমের পরিবেশ ভালো ছিল না বলেই খবর পাওয়া যাচ্ছিল সংবাদমাধ্যমে। কোচ সেতিয়েন-কে নিয়ে ঝামেলা চলছিল বেশ। মেসি সহ বাকি সহ খেলোয়াড়েরাও অসন্তুষ্ট ছিলেন কোচের খেলার পদ্ধতিতে। একের পর এক ভুল টিম স্ট্রাকচার, ডিসিশন আর স্ট্র্যাটেজির অভিযোগ লেগেই ছিল। লা লিগাতে দু’পয়েন্টে এগিয়ে থেকে করোনা পরবর্তী সময়ে খেলা শুরু করার পরে লীগ দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল বার্সেলোনাকে। উয়েফা চাম্পিয়ন্স লীগেও যেন ফিরে এল সেই দুঃস্বপ্নই।

রাউন্ড অফ সিক্সটিনে নাপোলির বিরুদ্ধে গত ম্যাচে লিওনেল মেসির অতিমানবিক দক্ষতায় জয়লাভ করেছিল বার্সা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী জার্মান দলটি প্রমাণ করে দিল টিম গেমই শেষ কথা ফুটবলে। একান্ত দক্ষতায় ম্যাচ বের করে আনা যায় না। ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী জার্মান দলটির বিরুদ্ধে কোনও কাজে আসেনি ব্যক্তিগত প্রতিভা। বেশ কয়েকবার মেসির বাঁ পা ঝলসে উঠলেও কোথাও যেন ট্র্যাপে পরে গেলেন ফুটবল রাজপুত্র। বায়ার্নের নিখুঁত ম্যানমার্কিং-এর কথা অবশ্যই বলতে হয়। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকে, সেভাবে কি সাপ্লাই পেয়েছিলেন মেসি? বেশ কয়েকটি সুযোগ সাজিয়ে দেওয়ার পরেও সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলেন সতীর্থরা। প্রথম তিরিশ মিনিটেই চার গোল খাওয়ার পর যে-কোনো বড়ো খেলোয়াড়েরও মনোবল পড়ে যায়। রিসিভ করার পরেও মেসির পা থেকে বল ছিনিয়ে নেওয়ার একাধিক দৃশ্য সেই কথাকেও মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

অন্যদিকে বার্সেলোনার ডিফেন্স নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তো ছিলই। বায়ার্ন-ম্যাচের পর আরও গাঢ় হল সেই দাগ। প্রথম হাফে চার-চার বার বল জালে জড়ানোর পরেও সতর্ক হল না বার্সেলোনা। ডিফেন্স লাইনে যে স্পষ্টতই মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর অভাব রয়েছে, গোটা নব্বই মিনিট জুড়েই ফুটে উঠল তা। হয়তো আরও বেশি গোল হজম করতে হত বার্সেলোনাকে। মিসপাস তো ছিলই। প্রতিটা ব্যাকপাসই বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছিল বার্সেলোনার বক্সে। পাশাপাশি প্লেয়ারদের গতিবিধিও ট্র্যাক করতে হিমশিম খেয়েছে বার্সেলোনার ডিফেন্স। গোটা সিসনে বায়ার্নের মূল হাতিয়ারই ছিল লং থ্রু। সেই মারণাস্ত্রের কথা জেনেও ক্লিয়ারেন্সে বড়ো ফাঁক রয়েই গেল কোয়ার্টার ফাইনালে।

অভিজ্ঞতা কিংবা দক্ষতার কোন অভাবই ছিল না দুই দলেই। কিন্তু কোথাও যেন প্রশ্নচিহ্ন হয়ে থেকে যাবে বার্সেলোনার টিম সিলেকশন নিয়ে। এরকম অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ফরাসি স্ট্রাইকার আন্তোনিও গ্রিজম্যানকে কেন প্রথম থেকে দলে রাখা হল না? আর্তুরো ভিদালের পারফরম্যান্স নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠলেও তাঁকে কেন খেলানো হল পুরো ম্যাচে? এ-বিষয়ে ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে খটকা থেকে যেতে বাধ্য। উল্টোদিকে বার্সেলোনা লোনে যে কুটিনহোকে ছেড়ে দিয়েছিল বছরের শুরুতেই। সেই কুটিনহোই শেষ দশ মিনিটে প্যারেন্ট ক্লাবের কফিনেই দু-দুটি পেরেক পুঁতে দিল।

গত এক দশকের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে বার্সেলোনার সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বায়ার্ন মিউনিখই। ২০১২, ১৬তে বার্সেলোনার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বায়ার্ন। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সেই ইতিহাসেরই যেন পুনরাবৃত্তি হল। সেইসঙ্গেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে নতুন মাইলস্টোন লিখে দিল বায়ার্ন মিউনিখ। এই প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লীগের মতো টুর্নামেন্টে ৮ গোল করল জার্মান দলটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্যায়ে দ্রুততম চার গোল করার কৃতিত্বও ঢুকল তাদের ঝুলিতেই। অন্যদিকে সাত দশক পর বার্সেলোনা হজম করল এক ম্যাচে ৮ গোল। ১৯৪৬ সালে সেভিয়ার স্মৃতি যেন আরও একবার উসকে দিল বায়ার্ন।

মাসকয়েক আগেই ক্লাব ছাড়ার ব্যাপারে সুর চড়িয়েছিলেন মেসি। ম্যাচের পরে জেরাড পিকের মুখেও যেন সেই কথাই ফিরে এল। “প্রয়োজন পড়লে ক্লাব ছাড়তে রাজি আছি। দলে নতুন খেলোয়াড়ের দরকার।” বিগত ম্যাচগুলিতে জয় মিললেও বার্সেলোনার মধ্যে যে ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট হয়ে এসেছিল, তার জন্য এই হার কোথাও হয়তো দরকার ছিল। মেসি-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার কথা বোঝার দরকার ছিল কোচের ক্ষেত্রেও।

তবে এই ম্যাচের পর চ্যাম্পিয়ন্স লীগের রোমাঞ্চ যেন বেড়ে গেল আরও খানিকটা। নিজেদের অন্যতম ভয়ঙ্কর দল হিসাবেই আরও একবার প্রমাণ করল বায়ার্ন। সেমিফাইনালে এখনও একমাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা দল তারাই। দুই সেমিফাইনালিস্ট লিপজিগ ও পিএসজিও এর আগে পায়নি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের স্বাদ। কখনো জেতেনি শেষ কোয়ার্টার ফাইনালের দুই দল অলিম্পিয়াকোস এবং ম্যান সিটিও। এখন দেখার, শেষ হাসি কি জার্মান আর্মিই হাসবে নাকি উঠে আসবে নতুন কোনো ডার্ক হর্স...

Powered by Froala Editor

More From Author See More