বেতন মাত্র ২ টাকা, পদ্মশ্রী পাচ্ছেন বর্ধমানের 'পাঠশালা'র গুরুমশাই

ঘরের লাগোয়া লম্বা বারান্দা, মাথার উপরে টালির ছাদ। সেখানে সার দিয়ে বসে আছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা। আর তাদের মাঝে এক অশীতিপর বৃদ্ধ। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। শীতে বড়জোর একটা চাদর। সকাল হোক কি সন্ধে, বিরাম নেই তাঁর। একনিষ্ঠভাবেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন পঠনপাঠনের কর্মসূচি— মানুষ তৈরির কারখানা। আর বেতন? মাত্র দু'টাকা। সুজিত চট্টোপাধ্যায়। বর্ধমানের আউশগ্রামের এই শিক্ষক এবার স্বীকৃতি পেলেন তাঁর এই অসামান্য উদ্যোগের। ২০২১ সালের পদ্মশ্রী পুরস্কার পেতে চলেছেন তিনি।

চারপাশের হিংস্রতা, অত্যাচার, হানাহানি পেরিয়েও আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে। পালন করছেন সমাজের প্রতি তাঁদের কর্তব্য। সুজিত চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। এককালের রামনগর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এখন ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর মাস্টারমশাই। ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। আর তাদের ৮০%-ই মেয়ে।

সুজিতবাবুর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল অবসর গ্রহণের পরে। ২০০৪ সালে। একদিন তিনজন ছাত্রী এসে তাঁর কাছে পড়ার জন্য অনুরোধ করে। কন্যাসমা ছাত্রীদের অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি। সেই থেকেই শুরু ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’। ৩ থেকে আজ সংখ্যাটা ৩০০ পেরিয়েছে, কিন্তু মাস্টারমশাই আগের মতোই আছেন। এখনও ক্লাস শুরু হয় সকাল ছ’টায়। শেষ হয় সন্ধে ছ’টায়। স্কুলের মতো নিয়মের কড়াকড়ি আছে এখানেও। আছে রেজিস্ট্রারের খাতা, হয় পেরেন্ট-টিচার মিটিংও। সুজিতবাবু বেতন নেন বছরে মাত্র দু’টাকা। বেতন না বলে সাম্মানিক বলাই ভালো। ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। কেউ বা আসছেন নিতান্ত দুঃস্থ পরিবার থেকে। স্কুলেও যেতে পারে না কেউ কেউ। তাদের জন্যই সুজিতবাবুর এই প্রয়াস। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৭ বছর।

আউশগ্রামের সবথেকে কাছের কলেজ ৩২ কিলোমিটার দূরে। গ্রামে ভালো স্কুলেরও অভাব রয়েছে। এজন্য সরকারি আধিকারিকদের চিঠিপত্রও লিখেছেন বিস্তর। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় যথেষ্ট ভালো ফলাফল করে। সুজিতবাবু তাঁদের পড়ান বাংলা ও ভূগোল। কলেজ পড়ুয়াদের পড়ান বাংলা। মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ার জন্য ৪০-৪২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের কাছে নস্যি।

শুধু পড়ানোই নয়, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য সুজিতবাবু অনুদানও সংগ্রহ করেন। এখনও অবধি তিনি ৬০টি শিশুর জন্য অনুদান তুলেছেন। সম্প্রীতি তিনি দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পেয়েছেন।

তাঁর মতো মানুষেরা আজও দেশের গর্ব। তাঁর অবদান কোনো পুরস্কারে মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু আজ তাঁরা আছেন বলেই আমরা এখনও বিশ্বাস করি, শিক্ষকরা 'মানুষ গড়ার কারিগর’।

আরও পড়ুন
এ-বছর পদ্মশ্রী পুরস্কার পাচ্ছেন যে দশ বাঙালি

ছবি ঋণ - The Better India

Powered by Froala Editor

Latest News See More