৯৬ বছর আগে, বাংলায় শব্দবিজ্ঞানের বই লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা শেষ পর্যন্ত তেমন একটা দানা বাঁধেনি। তবে বিশ শতকের শুরুতে এদেশের বিজ্ঞানী ও শিক্ষকরা যে প্রাণপাত পরিশ্রম করে গেছেন সে ইতিহাস মোটামুটি আমরা সকলেই জানি। তাঁদের নানান পরীক্ষানিরীক্ষা আজও আমাদের ভাবায়। আর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কথা বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় শ্রী জগদানন্দ রায়ের কথা। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্কুলের শিক্ষক জগদানন্দের শিক্ষাদানের ধরণ সম্বন্ধে খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখা বইগুলোতে। আমরা তাঁকে মূলত কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসাবে চিনলেও বিজ্ঞানশিক্ষা বিষয়ক বইই তিনি বেশি লিখেছেন।

১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় জগদানন্দের বই 'শব্দ'। শব্দবিজ্ঞানের বিবিধ তত্ত্ব নিয়ে লেখা এই বইয়ের পাঠক মূলত 'ছেলেমেয়েরা', অর্থাৎ অল্প বয়সের পড়ুয়ারা। ২৪টি অধ্যায়ে তিনি সবিস্তারে আলোচনা করেন 'শব্দ' সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থেকে ফোনোগ্রাফ যন্ত্রের প্রযুক্তি। আর এই বিরাট বিষয়বস্তুকে তিনি ধরেছেন মাত্র ১২৮ পৃষ্ঠার দুই মলাটের মধ্যে।

বিজ্ঞানের বই মানেই যে ভয়ের উদ্রেক করে, তা যেন এই বইয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি। নেই কোনো জটিল যন্ত্রপাতির কথা। কারণ লেখক ভেবেছেন, "সাধারণ পাঠক সেগুলিকে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিবার সুবিধা পাইবেন না।" অথচ শব্দতরঙ্গের যাবতীয় জটিল পরীক্ষানিরীক্ষা আলোচনা করা হয়েছে। আর এই কাজে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন তৎকালীন বাঙালির নিজস্ব জীবনযাত্রা থেকে। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে এই ধরণের উদাহরণ দেওয়ার কথা বলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যান। কারণ পড়ুয়াদের সারাদিনের জীবনযাত্রা নিখুঁত পর্যবেক্ষণের পরিশ্রম বিস্তর। আর জগদানন্দের লেখায় সেই কাজের প্রতি নিষ্ঠাই আরও বেশি করে আশ্চর্য করে।

আশ্চর্য করে বইটিতে বৈজ্ঞানিক পরিভাষার ব্যবহারও। 'sound wave'-এর বাংলা তর্জমায় তিনি লিখছেন 'শব্দের ঢেউ'। 'Medium of sound'এর তর্জমা শব্দের বাহন। 'শব্দতরঙ্গ', 'শব্দের মাধ্যম'এর মতো কঠিন পরিভাষার ব্যবহার নেই বইয়ের কোথাও। যেন বাচ্চাদের সাথে কথা বলার ভঙ্গিতেই লেখা হচ্ছে সবটা।

গল্পের ছলে বিজ্ঞানপাঠ দেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল লেখকের। তাঁর কল্পবিজ্ঞান বর্গের রচনাতেও সেই ছাপ পাওয়া যায়। শিশুমনের কল্পনাকে ব্যবহার করে সহজ ভঙ্গিতে বলে গেছেন বিজ্ঞানের নানান জটিল তত্ত্ব। কৃষ্ণনগরের মিশনারী স্কুলে পড়ার সময় বিজ্ঞানের প্রতি যে আকর্ষণ তিনি পেয়েছিলেন, সেই আকর্ষণ তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সংক্রমিত করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। 'শব্দ' যেমন আজকের পড়ুয়াদের কাছেও বিজ্ঞানপাঠের অসাধারণ একটি বই, সেইসঙ্গে শিক্ষাবিজ্ঞানের আলোয় এই বইয়ের ভাষাকে নতুন করে পাঠ করাও সময়ের দাবি রাখে।