মূর্তিপূজা নয়, মহিষাসুরমর্দিনী পাঠেই শারদীয়া উদযাপন বেঙ্গালুরুর বাঙালিদের

পুজো মানেই নতুন জামা কাপড়। পাড়ার মাইকে বাজতে থাকা গান। আলোর রোশনাই। বন্ধু কিংবা পরিবারের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া মণ্ডপে মণ্ডপে। নিদেনপক্ষে ঘরোয়া জমায়েতেই ভাঙিয়ে নেওয়া বহুদিনের জমে থাকা আড্ডার খেদ। কিন্তু বাড়ি থেকে বহু দূরে ভিন শহরে যাঁরা? তাঁদের কেমন করে কাটে পুজো? অনেক জায়গাতেই প্রবাসীরা দলবদ্ধ হয়েই আয়োজন করেন উৎসবের। তবে বেঙ্গালুরুর প্রবাসী সংগঠন ‘ঋতজ’-এর উৎসব উদযাপন একটু অন্যরকমই। অভিনবও বলা চলে।

পঞ্চমী, ষষ্ঠী নাকি সপ্তমী— কবে থেকে শুরু হয় পুজো? মণ্ডপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন যবেই হোক না কেন পুজোর মেজাজ বাংলায় গড়াতে শুরু করে মহালয়া থেকেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ দিয়েই তার সূচনা। যে অনুষ্ঠানের সঙ্গেই জুড়ে আছে হাজারো নস্টালজিয়া। ১৯২৬ সাল থেকে ষাটের দশক অবধি রেডিয়োয় এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমেই শুরুয়াত হয়ে আসছে দেবীপক্ষের। আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ছাড়া মানে হয় না পুজোর।

সেই সংস্কৃতিকেই ধরে রেখেছেন বেঙ্গালুরুর প্রবাসী বাঙালিরা। মূর্তি পুজো নয়। বরং প্রতি বছর পুজোর আগে সেই ঐতিহাসিক ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সুরেই তাঁরা আপ্যায়ন করেন দেবীকে। কেউ ভাষ্যপাঠে, কেউ গানে, কেউ বা স্তোত্রপাঠেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন সেই অনুষ্ঠান। এভাবেই গড়ে ওঠে পুজোর আবহ। এভাবেই শুরু হয় তাঁদের পুজো উদযাপন।

“প্রতিবছর মহালয়াতেই আমরা এই অনুষ্ঠান করি। আমাদের পুরাতনী লোকসংস্কৃতিতে মা দুর্গাকে ঘরের মেয়ে হিসাবেই দেখা হয়। সেইভাবটাকে রেখেই মূলত আমরা এই অনুষ্ঠানটা করি। মহিষাসুরমর্দিনী পুরো না হলেও চণ্ডীপাঠ এবং সেই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন গানও গাওয়া, এভাবেই হয় আমাদের অনুষ্ঠান।”, জানালেন ঋতজের সদস্য অভিনব বসু। 

আরও পড়ুন
পুজোয় বন্ধ ম্যাডক্স স্কোয়ারের বিখ্যাত আড্ডা; বাদ দর্শনার্থীরাও?

তবে শুধু এই ছোট্ট দল ঋতজের সদস্যরাই থাকেন না এই অনুষ্ঠানে। অংশ নিতে হাজির হন বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাসীরাই। রীতিমতো কোনো সামাজিক ভবন ভাড়া করেই হয় এই অনুষ্ঠান। অন্যেরা পাঠে কিংবা সুরে অংশ না নিলেও, ভাসেন এই পুজোর আবহে। ছন্দে ছন্দে তাঁদের মধ্যেও শুরু হয়ে যায় পুজো উদযাপনের আমেজ।

বছর তিনেক আগে শুরু হয়েছিল ঋতজের এই পথ চলা। বেঙ্গালুরুতে তখন সদ্য খুলেছে আনন্দ পাবলিশার্সের বই-বিপণি। মাঝে মাঝেই সেখানে গান, কবিতা-পাঠের অনুষ্ঠান চলত বছর ধরে। লেগে থাকত পাঠকদের আনাগোনা। তাঁরাই মূলত গায়ক-গায়িকা কিংবা পাঠক-পাঠিকা ছিলেন এই অনুষ্ঠানের। বাংলা বইয়ের হাত ধরেই প্রথমে আলাপ। তারপর সেখান থেকে গভীর হয় বন্ধুতা। কিছু বাংলা বইপ্রেমী মিলেই গড়ে তোলেন একটি ছোট্ট দল। জন্ম নেয় ‘ঋতজ’।

রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের মাধ্যমেই প্রথম নিজেদের খুঁজে পান ‘ঋতজ’-এর সদস্যরা। তারপর আরও বেশ কিছু অনুষ্ঠানের পরে পরিকল্পনা হয় ২০১৮-র শারদীয়া উদযাপন একটু অন্যভাবে করার কথা। হয়ও অনুষ্ঠান। আর সেই অনুষ্ঠানই মিলিয়ে দেয় ব্যাঙ্গালোরের বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালিদের। 

আরও পড়ুন
দর্শকহীন পুজোর সিদ্ধান্ত সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের, একই পথে হাঁটবে অন্যরাও?

তবে শুধুই যে চণ্ডীপাঠ বা মহিষাসুরমর্দিনীর গান, তা নয়। বরং উমার আগমনের কথা মাথায় রেখে অন্যান্য গানও হয় ঋতজের এই অনুষ্ঠানে। তবে বাংলাতেই। অনেকে স্বরচিত গান কিংবা কবিতাও উপস্থাপনা করেন অনুষ্ঠানে।

তবে এই বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই জমায়েতের। সামনাসামনি না হলেও ভার্চুয়াল পথকেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন ‘আনন্দময়ীর আগমন’-এর জন্য। মহালয়া পুজোর এক মাস আগে হওয়ায় পেছাতে হয়েছে অনুষ্ঠানের তারিখও। আগামী রবিবার প্রত্যেকে বাড়িতে থেকেই অনলাইনে পুজোর আনন্দে মাতবেন ঋতজের সভ্যরা। আহ্বান করবেন দেবী দুর্গাকে। 

এবছর অনলাইনে এই উৎসব হওয়ায় আরও খানিকটা বাড়তি সুবিধাও পাচ্ছে ঋতজ। বীরেন ভদ্রের কালজয়ী মহিষাসুরমর্দিনীর সঙ্গেই তাঁরা মিশিয়ে দিচ্ছেন বাঙালির আরেক নস্টালজিয়াকে। দূরদর্শনে যে মহালয়া দেখা যেত সকালের আলো ফুটলেই, সেই মহালয়ার নাচকেও অনুষ্ঠানের সূচিতে জুড়ে নিয়েছে ঋতজ। মূর্তি, চাকচিক্য, আয়োজন ছাড়াও অতি সাধারণভাবেই এভাবে চলছে দেবীর অবাহন। সেখানে মিশে যাচ্ছে ইতিহাস, নস্টালজিয়া, বাঙালিত্ব। আর এই উদযাপনের মধ্যে দিয়েই নিজের শহর ছেড়ে দূরে থাকা মানুষগুলোও আনমনেই আওড়ে নিচ্ছেন, ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’। এই পুজো সত্যিই অভিনব, তাতে সন্দেহ নেই কোনো...

আরও পড়ুন
ফিরছে ডবল ডেকার বাস, পুজোয় নস্টালজিয়ার ছোঁয়া কলকাতায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More