নিগ্রহকারীকে সপাটে চড় মারলেন সারদামনি

রামকৃষ্ণ ও সারদামনির আশ্চর্য দাম্পত্য অনেকের কাছেই আলোচনার বিষয়। সে যুগে, অশিক্ষিত, উপার্জনহীন, পরমুখাপেক্ষী গৃহবধূরা যখন নিত্য গার্হস্থ্য অবমাননা ও হিংসার শিকার হতেন, এবং মুখ বুজে সহ্য করে নিতে বাধ্য হতেন, তখন পত্নীর প্রতি অদ্ভুত সম্মানবোধের আদর্শ দেখিয়েছেন রামকৃষ্ণ। উত্তরকালে সারদামনি স্মৃতিচারণ করেছেন, "তিনি আমার সঙ্গে কী ব্যবহারই করতেন! একদিনও মনে ব্যথা পাবার মতো কিছু বলেননি।" আরও জানাচ্ছেন, "তিনি কখনও আমাকে 'তুই' পর্যন্ত বলেননি। ঠাকুর আমাকে কখনও ফুলটি দিয়েও ঘা দেননি; কখনও 'তুমি' ছাড়া 'তুই' বলেননি।" 

দক্ষিণেশ্বরে একদিন স্বামীর ঘরে গিয়ে খাবার রেখে আসছেন সারদা দেবী, অন্যমনস্ক রামকৃষ্ণ ভাবলেন - লক্ষ্মী (তাঁর ভাইঝি) বুঝি খাবার দিয়ে গেল, বলে উঠলেন, "দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস।" সারদা দেবী বললেন, "হাঁ, দরজা ভেজিয়ে রাখলুম।" পত্নীর কণ্ঠস্বরে তৎক্ষণাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন ঠাকুর, মার্জনাভিক্ষার সুরে বলে উঠলেন, "আহা, তুমি! আমি ভেবেছিলুম লক্ষ্মী- কিছু মনে করো না।" কেবলমাত্র ভুল করে একবার 'তুই' বলে ফেলেছেন বলে তাঁর এত সঙ্কোচ! "(সর্বদা) কীসে ভালো থাকব তাই করেছেন।" - বলেছেন সারদামনি।

স্বাভাবিক ভাবেই, রামকৃষ্ণের কাছে এই দুর্লভ সম্মান লাভ করে নরনারীর দাম্পত্য সম্পর্কে সারদা দেবীর মনে এক উচ্চ আদর্শ জেগে ওঠে। তাই ভবিষ্যতে তিনি পরিচয়হীন দরিদ্র প্রতিবেশিনীর জন্যও সরব হয়ে উঠতে দ্বিধা করেননি। বাগবাজারে তাঁর বাসগৃহের কাছে কয়েক ঘর দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষের বাস ছিল। একদিন সেদিক থেকে এক বধূর কান্নার আওয়াজ ভেসে এল, তার স্বামী তাকে প্রবল মারধোর করছে। সকলকে অবাক করে দিয়ে সারদামনি তীব্র ভাষায় গর্জন করে উঠলেন, "ওরে ও মিনসে, বউটাকে কি একেবারে মেরেই ফেলবি নাকি?" সারদা দেবীর আকস্মিক তিরস্কারে ভয় পেয়ে লোকটি তখনই সংযত হল। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েদের দাম্পত্যজীবনে তুচ্ছ কারণে পরস্পরকে অসম্মান ও অশান্তির বৃত্তান্ত শুনে তিনি অবাক বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন, "তোমাদের কি এরকম হয়? ঠাকুরের সঙ্গে তো আমার এরকম কখনও হয়নি - এসব জানি না।"

সেকালের সমাজে সারদা দেবী খুব বেশি লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। শৈশবে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় গিয়ে অল্পস্বল্প পড়াশোনা করেছিলেন। বিবাহের পর কামারপুকুরে লক্ষ্মীর সঙ্গে তিনি বর্ণপরিচয় পাঠ করতেন। ঠাকুরের ভাগনে হৃদয় বই কেড়ে নিয়ে বলল, "মেয়েমানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই, শেষে কি নাটক নভেল পড়বে?" লক্ষ্মী তার বই ছাড়ল না, জোর করে ধরে রাখল। সারদা দেবী গোপনে এক আনা দিয়ে আরেকখানি বই কিনে আনালেন। লক্ষ্মী পাঠশালা থেকে পড়ে আসত, এসে সে আবার সারদা দেবীকে পড়াত।

তাঁর ভালো করে লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছিল দক্ষিণেশ্বরে। এক স্নানার্থিনী ভদ্রমহিলার থেকে রোজ একটু একটু করে পাঠ নিয়েছিলেন তিনি, বদলে তাকে দিয়েছিলেন শাকপাতা ও বাগানের অন্যান্য দ্রব্য। বিদ্যাশিক্ষার জন্য সেকালের এই অসামান্যা মানবীর অদম্য উৎসাহ দেখে আমাদের বারবার বিস্মিত হতে হয়! 

নিজে খুব বেশি লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু অন্য মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে সারদা দেবীর প্রবল আগ্রহ ছিল। নিজের ভাইঝি রাধু ও মাকুকে তিনি উৎসাহভরে লেখাপড়া করিয়েছিলেন। তাদের দিয়ে চিঠিপত্র লেখানো ও ধর্মগ্রন্থাদি পাঠ করাতেন তিনি। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেও রাধুকে ইস্কুলে যেতে দেখে তাঁর এক সঙ্গিনী আপত্তি প্রকাশ করায় তিনি পিছিয়ে আসেননি, বরং বলেছেন এতে ক্ষতি নেই, লাভ আছে। রাধুর যে অঞ্চলে বিয়ে হয়েছে, সেখানে মেয়েদের তেমন শিক্ষার চল নেই, রাধুর দ্বারা তাদের উপকার হবে। 

এক ভক্তমহিলা তাঁর পাঁচটি অবিবাহিতা মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করায় সারদামনি বলেছিলেম, "বে দিতে না পারো, এত ভাবনা করে কি হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দিও, লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।" ভগিনী নিবেদিতার স্কুল নিয়ে, ভারতীয় নারীদের শিক্ষালাভ ও সর্বাঙ্গীন উন্নতির ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ থেকে সারদামনি সর্বদা তাঁকে উৎসাহ দিতেন। মাদ্রাজের দুইটি কুমারী মেয়ে সেই ইস্কুলে ছিল, তাদের বয়স বিশ-বাইশ বছর। মেয়ে দুটির স্বাধীন আলোকপ্রাপ্ত জীবনের প্রশংসা করে সারদা দেবী বলেছিলেন, "আহা, তারা কেমন সব কাজকর্ম শিখেছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আট বছর হতে না হতেই বলে, 'পরগোত্র করে দাও! পরগোত্র করে দাও! আহা, রাধুর যদি বিয়ে না হতো, তাহলে কি এত দু:খদুর্দশা হতো?" প্রচলিত সমাজবিধিকে অস্বীকার করে, সারদা দেবী যে কেবল বাল্যবিবাহের সমালোচনা করলেন তাই নয়, তিনি মেয়েদের অবিবাহিত জীবন যাপনের ব্যাপারেও উৎসাহ প্রকাশ করলেন। স্পষ্টতই, যুগের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন তিনি।

সেকালে দাম্পত্যের আরেকটি সমস্যা ছিল জন্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাব। এতে কেবল অর্থনৈতিক অসুবিধা হত তাই নয়, বারবার গর্ভধারণ ও প্রসবের কষ্ট সহ্য করে মেয়েদের শরীরও ভেঙে যেত। এ ব্যাপারেও সারদা দেবী সরব হয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, "ঠাকুর বলতেন দু-একটি ছেলে হওয়ার পর সংযমে থাকতে।... ইন্দ্রিয়সংযম চাই।" 

শেষ করব একটি অসামান্য প্রসঙ্গ দিয়ে। বদ অভিসন্ধিযুক্ত পুরুষদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়, শ্রীমা সারদা দেবী সে দৃষ্টান্ত নিজে হাতে-কলমে করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অবলা নয়, নারীকে হয়ে উঠতে হবে সবলা। কারোর সাহায্যের মুখাপেক্ষী নয়, নিজেকেই করতে হয় অন্যায়ের প্রতিকার। কীভাবে? তাঁর কথাতেই বলি...

"...একদিন আমি পাশের বাড়ি থেকে আসছি। এসে বাড়ির ভিতর যেই ঢুকেছি, অমনি হরিশ আমার পিছুপিছু ছুটছে।... তখন বাড়িতে আর কেউ নেই। আমি কোথায় যাই। তাড়াতাড়ি ধানের হামারের চারদিকে ঘুরতে লাগলুম। ও আর কিছুতেই ছাড়ে না। সাতবার ঘুরে আমি আর পারলুম না। তখন নিজ মূর্তি এসে পড়ল। আমি নিজ মূর্তি ধরে দাঁড়ালুম। তারপর ওর বুকে হাঁটু দিয়ে জিভ টেনে ধরে গালে এমন চড় মারতে লাগলুম যে, ও হেঁ হেঁ করে হাঁপাতে লাগল। আমার হাতের আঙুল লাল হয়ে গিছল।"

এমন শক্তিময়ীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত না হয়ে উপায় আছে কোনো?

Powered by Froala Editor