আর কিছুদিনের মধ্যেই বাপের বাড়ি আসছেন মা দুর্গা। মৃৎশিল্পীরা গড়ে তুলছেন মায়ের প্রতিমা। তবে তাকে সাজিয়ে তুলতেও তো হবে। আর মায়ের সাজের কথা বললেই এখনও নিজের ঐতিহ্যে অচল ডাকের সাজ। শুধুই তো পুজো নয়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের মানে নানা মানুষের একসঙ্গে জড়িয়ে ওঠা। তবে এবছর যেন প্রত্যেকেরই কেমন মনখারাপ করা মেজাজ। সবার মনেই দুশ্চিন্তা। পূর্ব বর্ধমান জেলার বনকাপাশি গ্রামের অবস্থাও তাই এখন অন্যান্য বছরের থেকে একেবারে আলাদা।
‘শোলাশিল্প গ্রাম’ নামে পরিচিত বনকাপাশি। ৫৩ বছরের প্রবীন শিল্পী আশিস মালাকার বলছিলেন, “আমাদের গ্রামে লোকসংখ্যা ২ হাজারের মতো। তার মধ্যে ১৮০০ মানুষই শোলা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।” হ্যাঁ, এখানে শিশুরা হাতে পেনসিল তুলে নেওয়ার আগেই তুলে নেয় ধারালো ছুরি। তারপর শুরু হয় লম্বা লম্বা শোলার ডাল থেকে নক্সা তোলার শিক্ষা। এভাবেই দিন চলে প্রতিটা পরিবারের। আর প্রত্যেক শিল্পীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় দুর্গাপুজো। ডাকের সাজের চাহিদা আজও পুরো হারিয়ে যায়নি।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে দুর্গাপুজো হবে কিনা তাই নিয়েই তো সংশয় ছিল কিছুদিন আগে পর্যন্ত। এখন সেই সংশয় মিটলেও হাতে কাজ সেভাবে পাননি শোলা-শিল্পীরা। শিল্পী রাধামাধব ঘোষের কথায়, “অন্যান্য বছর যেখানে ৩০০-র বেশি অর্ডার পাই, এবছর পেয়েছি মাত্র ২৫টা। তাও সবই ছোটো প্রতিমার সাজ। বড় কোনো অর্ডারই হাতে নেই।” আবার ১৯৯০ সালের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী আশিস মালাকারের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাঁর কথায়, “আমি তো ছোটো কাজের অর্ডার পাই না। কয়েকটা বড়ো অর্ডার পেলেই চলে যায়। এবছর একটাও পাইনি।” তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, “আমাদের মঞ্চে ডেকে সম্মান জানান অনেকে। কিন্তু এই মহামারী পরিস্থিতিতে যে কেমন আছি, সেখবর কেউই রাখেননি।”
করোনা পরিস্থিতি যেন একটা গ্রামের মুখ থেকে সমস্ত হাসি মুছে নিয়েছে। তবে অন্যান্য বছরেও যে অবস্থা খুব ভালো থাকে তেমনটা কিন্তু নয়। শিল্পী আশিস দত্তের কথায়, “ছোট থেকে আর কিছুই তো শেখা হয়নি, নাহলে সত্যিই এখন এই কাজে আর দিন চলে না।” তাঁর কথায়, “আমাদের ইউনিয়ন না থাকাই সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ। ক্রেতারা ঠিকমতো দাম দিতে চান না। আমরা কোনো নির্দিষ্ট দাম বেঁধে নিতেও পারি না।” অন্যদিকে ক্রমাগত কাঁচামালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। শোলার জোগানও আর প্রায় নেই বললেই চলে। কাগজ, চুমকি, জরি - সমস্তকিছুর দাম বাড়ছে। কিন্তু ডাকের সাজের চাহিদা নিম্নমুখী। তাতেও দাম মেলে না।
আরও পড়ুন
বেলুড় মঠে এবার ভক্তদের প্রবেশ নিষেধ, অনলাইনেই দেখতে হবে পুজো
ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেও এগিয়ে আসেন না কেউ। অথচ বিদেশের বাজারে এখনও শোলাশিল্পের যথেষ্ট চাহিদা আছে বলেই জানাচ্ছেন আশিস মালাকার। কিন্তু সে-বিষয়েও কোনো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। “কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের টাকা পাইনি ২ বছর ধরে। ব্যাঙ্কে ঘুরে ঘুরে জুতোর শুকতলা খয়ে ফেলেছি। করোনা পরিস্থিতিতে খেতে পাচ্ছি কিনা সে খবরই রাখেন না কেউ। আর কিছু আশা করি কী করে?” বলছিলেন আশিসবাবু। পুরস্কার তো পেট ভরায় না। সেটাই যেন এই পরিস্থিতিতে আরও বড়ো বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো ধীরে ধীরে বিকল্প জীবিকা খুঁজে নেবেন গ্রামের মানুষ। আর সেইসঙ্গে হারিয়ে যাবে শোলাশিল্পের ঐতিহ্যও।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
এগিয়ে আসছে পুজো, করোনাকালে কেমন আছেন কুমোরটুলির ‘বিশ্বকর্মা’র সন্তানরা?