সময় পাল্টালেও তিনি অবিচল, একমনে গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে চলেছেন তাপসবাবু

গলায় সুর থাকুক আর না-ই থাকুক, গান শুনতে ভালোবাসেন সবাই। একেক জনের এক এক রকম রুচি। সেই মতো সময় পেলেই পছন্দের গানটি চালিয়ে বসে থাকা, কখনও আপন মনেই গুনগুন করে ওঠা। যেন ওষুধের মতো আমাদের আশ্রয় দেয় সেসব সুর। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই যাবতীয় গান শোনার মাধ্যম কী? সেই নেট, এবং মোবাইল। এরকমটা উচিত কিনা, সে প্রশ্নও জোরালো হচ্ছে। তবে আমাদের আজকের কাহিনি সেসব নিয়ে নয়।

যদি বলা হয় আবার ক্যাসেট বা গ্রামোফোনে ফিরে যেতে, কজন যাবেন? কয়েকজন হয়ত ঠিকই সেই পথ বেছে নেবেন। সেই দলেই থাকবেন তাপস চট্টোপাধ্যায়। নাম শুনলে হয়তো চিনতে পারবেন অনেকেই। তাপসবাবু একজন শিল্পী, গায়ক। তবে শুধু সেখানেই থেমে থাকে না তাঁর পরিচয়। তিনি এই শহরের একজন অন্যতম গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক। দীর্ঘ বহু বছর ধরে গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে আসছেন তিনি। বাড়িতেই তৈরি করেছেন বিশাল কালেকশন। যা শুনলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়; বিস্ময় নিয়ে তাকাতে হয় একটা লোকের নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও অধ্যাবসায়ের দিকে… 

লেকটাউনের কালিন্দীর বাসিন্দা তাপসবাবুর গ্রামোফোন সংগ্রহের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে। ঠিক কীভাবে এই চিন্তা এল? “বাড়িতে ছোটোবেলা থেকেই রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। তখন ক্লাস থ্রি। আমাদের সময় তো পেনড্রাইভ বা এত নেটের ব্যাপার ছিল না, গ্রামোফোন রেকর্ডই ছিল প্রধান। তারপর এল ক্যাসেট। কিন্তু ক্যাসেটেরও তো যত্ন রাখতে হয়, তাকে রোদে দিতে হবে। তা নাহলে খারাপ হয়ে যাবে। এবার রোদে রাখলেও সবসময় ঠিক রাখা সম্ভব হত না। ফলে অনেক ক্যাসেটই নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেকর্ডের কথাটা তুলল। গ্রামোফোন রেকর্ডকে ঠিকঠাক যত্ন করলে সেটা কোনোদিনও নষ্ট হয় না। সেই বন্ধুই এই রেকর্ড সংগ্রহের কথা আমাকে বলে। আমারও মাথায় খেলে গেল ব্যাপারটা। তারপ ১৯৯২ থেকে শুরু সংগ্রহ করা। প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল রাজেশ খান্নার ‘ফিফটি ফিফটি’। ব্যস, নেশায় ধরে গেল বাকিটা।”

সেই নেশা এখনও চলছে। হ্যাঁ, আজও একই উদ্যমে রেকর্ড সংগ্রহ করে চলেছেন তিনি। পুরনো দিনের গান ও তার দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড তো আছেই; রয়েছে হাল আমলের সিনেমার গানও। পুরনো দিনের বেশিরভাগই কিশোর কুমারের, তবে বাকিদেরও রয়েছে। আগে বাংলা গানের রেকর্ডই কেনা হত, তাপসবাবুই হিন্দির ধারাটা শুরু করেন। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারই হোক বা মুম্বই, দিল্লি— যখন যেখানে খবর পান সেখান থেকেই কেনেন। তবে একসময়ের এইচএমভি’র কথাও জানাতে ভোলেন না তিনি। সেই নস্টালজিয়া, সেই দোকান, ঐতিহ্য সবই তো হারাতে বসেছ বাঙালি… 

এক কথায় গ্রামোফোন রেকর্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায় তাপস চট্টোপাধ্যায়কে। কোন রেকর্ড কেমন, গ্রামোফোন পিন কত রকমের হয়, কোনটা ভালো কোনটা ঠিক— সমস্তটা তাঁর নখদর্পণে। অবাক হয়ে শুনে যেতে হয় সেসব কথা। নয় নয় করে রেকর্ডের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তবে তাজ্জব লাগল যখন তাপসবাবু বললেন, এখনও রেকর্ড প্লেয়ার তৈরি হয়। তবে সেটা ভারতে নয়, বিদেশে। এমনকি এখনকার আধুনিক সিনেমারও গ্রামোফোন রেকর্ড আছে! আর সবই টেঁকসই; যত্ন নিলে আপনার সঙ্গে থেকে যাবে অনেকদিন। সেই কথাই শোনা গেল তাপসবাবুর মুখে। একটু যত্ন, একটু নিষ্ঠা আর ভালোবাসা— এই তো চাই! 

লকডাউনের পরিস্থিতিতে সবাই বিপাকে পড়েছি। একদিকে করোনা, অন্যদিকে পেটের টান— সবদিকেই বাঁধা পড়ে আছি আমরা। তাপস চট্টোপাধ্যায়ের গলাতেও ঝরে পড়ল সেই হতাশা। “আমরা তো শিল্পী। গান গেয়ে পেট চলে। এখন সব বন্ধ। ঘরে যেটুকু টাকা আছে, সেটা দিয়েই চলছে। এত জনের জন্য সরকার এত কিছু করছে, কিন্তু আমাদের পাশে কি কেউ দাঁড়াচ্ছে? কেউ খোঁজ নিচ্ছে? যারা বাউল গান করেন, যারা মাটির মূর্তি তৈরি করেন সবাই তো শিল্পী। খোঁজ নিয়ে দেখুন, সবার অবস্থা খুব খারাপ। সবার কাজ বন্ধ। কিন্তু আমাদেরও তো বাঁচতে হবে। সেদিকে কারোর নজর নেই।” আর গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো? “যদ্দিন আছি, সংগ্রহ করে যাব। আমার পরের প্রজন্ম এসব নিয়ে উৎসাহী নয়। যাবার আগে ঠিক জায়গায় বিক্রি করে দেব, যারা এর কদর বুঝবেন।” দীর্ঘশ্বাস ঘনিয়ে আসে। শহরেও নেমে আসে আরেকটা সন্ধ্যা। শুধু হাহাকারগুলো একই থেকে যায়। তাপসবাবুর কথা সেখানেই এসে মেলে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More