এক ধাক্কায় ৩০০ বছর পিছিয়ে গেল ইউরোপের আধুনিক কবিতার ইতিহাস

রত্নখচিত অলঙ্কারের উপর প্রাচীন গ্রিক অক্ষরে লেখা চারটি পঙক্তি। অনুবাদে কথাগুলো দাঁড়ায় এরকম – ওরা বলে যায় / ওদের যা ইচ্ছা তাই / ওদের বলতে দাও / আমি পরোয়া করি না। লকডাউনের সময় পুরনো নথি ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই লাইনগুলো পড়েই থমকে গিয়েছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির(cambridge University) ক্লাসিক সাহিত্যের অধ্যাপক টিম হুইটমার্স। চমক লাগার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ক্লাসিক সাহিত্য বলতেই আমরা সাধারণত বুঝি একটানা অনেকগুলো অক্ষর জুড়ে জুড়ে বাক্য তৈরি হবে। আর তার ভাষাও ঠিক মানুষের কথ্য ভাষার মতো নয়। বরং অনেকখানি ভাবগাম্ভীর্য মিলে তৈরি হবে কাব্যের ভাষা। অথচ এই লাইনগুলো যে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রত্নসামগ্রীগুলোর নথি বলছে, এই পঙক্তি রচনার সময়কাল কিছুতেই তৃতীয় শতকের পরে নয়। অথচ আধুনিক কবিতার সঙ্গে তার সাদৃশ্য অবাক করার মতোই। আর এই আবিষ্কারের ফলে আধুনিক কবিতার বয়সও অন্তত ৩০০ বছর বেড়ে গেল, এমনটাই বলছেন হুইটমার্স।

এতদিন মনে করা হত, ইউরোপে আধুনিক কবিতার শুরু মোটামুটি পঞ্চম শতক। বাইজান্টাইন অঞ্চলের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের মন্ত্রের মধ্যে দিয়েই আধুনিক কবিতার শুরু ধরা হয়। আর এই আধুনিক কবিতার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল শ্বাসাঘাত। শ্বাসাঘাতের কারণেই ক্লাসিক যুগের বড়ো বড়ো পঙক্তি লেখার রীতি মুছে যায়। বদলে সহজপাঠ্য এবং ছোটো ছোটো পঙক্তি লেখা শুরু হয়। এই প্রত্যেকটা বৈশিষ্ট্যই আলোচ্য কবিতাটিতে বর্তমান। সেইসঙ্গে আরও যে বিষয়টি অবাক করে, এই কবিতার রচয়িতার নাম বা ছদ্মনাম কিছুই জানা যায় না। অথচ ইতিমধ্যে ২০টির বেশি লিপিতে পাওয়া গিয়েছে লাইনগুলি। শুধু তাই নয়, রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রাচীন শিলাফলকেই খোদিত আছে লাইনগুলি। ফলে কবিতাটি জনমানসে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাও বোঝা যায়। আর শুধু সাহিত্য বলে নয়, সমাজে আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণই হল জনমানসের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। তাই সব দিক থেকেই এই কবিতাকে আধুনিক বলে মেনে নিতে হয়।

হুইটমার্স আক্ষেপের সঙ্গে জানিয়েছেন, এতদিন এই নমুনা কারোর চোখে না পড়ার চেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। তিনি নিজেও হয়তো লক্ষ করতেন না। কারণ এই লাইনগুলি কোথাও কবিতা বলেই নথিভুক্ত ছিল না। তালিকায় তার পরিচয় ছিল লিপি হিসাবে। প্রাচীনযুগের আরও কত নিদর্শনই যে এভাবে আড়ালে থেকে গিয়েছে, তার হয়তো কোনো হিসাব নেই। তবে এই কবিতাটির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন হুইটমার্স। আর তা হল, একটি দেয়াললিপি ছাড়া কবিতাটি বাকি সব জায়গাতেই পাওয়া গিয়েছে অলঙ্কারের উপর খোদিত অবস্থায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গলার হারের লকেটের মধ্যে লেখা আছে লাইনগুলি। এর সঙ্গে হয়তো আজকের দিনে টি-শার্টে লেখা পঙক্তিরই সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আধুনিক কবিতার এমন জনপ্রিয়তাও খুব পুরনো নয়। সেখানে তৃতীয় শতকের এই পঙক্তি যেন সময়ের সমস্ত ধারণাকেই চুরমার করে দেয়।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
হেলেন কেলারের হাতে আঙুল চালিয়ে কবিতা ‘পড়ালেন’ রবীন্দ্রনাথ