দশ রকমের হাসি হেসে অজিতেশ বললেন, ‘এরকম হলে চলবে?’

‘উ বুড়ার কথা বাদ দেন, ডাক্তারবাবু। উ ঠিক করেছে, আমাকে দিয়ে কাজ করাবেকই। আর আমিও ঠিক করেছি শালা কাজ করিবক নাই। ঘরে যখন এতগুলান পয়সা আছে, তখন লতুন করে আর পয়সা করার দরকার কী, আপনিই বলুন। আমি বাবা দুনিয়া ভোগ কইরতে এসেছি। যদ্দিন বাঁইচব, ভোগ করি যাব, বুঝলেন। উ ত্যাগ-ট্যাগ আপনার সাধু-সন্নিসিরা করুক। সবাই যদি দুনিয়ায় সাধু-সন্নিসি হবেক, তবে দুনিয়াটা বাঁইচবেক কীকরে, বলুন তো! একী, আপনি হুইস্কি খেইলেন না যে বড়!’

পশ্চিমের একটা ছোট্ট পাহাড়ি গঞ্জের স্থানীয় জমিদার ছবিলালের ছেলে লছমনলাল এই কথাগুলো বলছে গঞ্জের মানুষ যাঁকে ভগবান মানে, সেই ডাক্তার অনাদি মুখার্জিকে। ডাক্তারবাবু মদ খান না শুনে তার ব্যঙ্গোক্তি ঠিকরে আসে-‘সবাই শালা সতী রে!’ তারপরেই উচ্চৈঃস্বর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার পালিশ করা মাস্তানি। জ্বলন্ত চোখ, সঙ্গে এমন চেবানো ডায়লগ থ্রোয়িংয়ের কাল্ট ক্যারেক্টারাইজেশন। সহকর্মীরা কি আর সাধে বলতেন, অজিতেশ চরিত্রে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যান!

আরও পড়ুন
চ্যাপলিনের ভাবশিষ্য জহর রায় দাঁড়িপাল্লায় তুলেছিলেন ব্রহ্মাকেও

শোনা যায়, ছাত্রদের উপর যাতে খারাপ প্রভাব না পড়ে, তাই লছমনলাল চরিত্রটি করার জন্য সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার দর্শক তাঁকে মনে রেখে দেবে নাট্যজগতের সংগ্রামী সম্রাট রূপে। নাটকের আঙিনায় তাঁর কর্মকাণ্ড সেই স্মৃতিরক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে মতবিরোধে দল ছেড়ে এড়িয়ে আসা, তারপর ‘নান্দীকার’, সেখানেও কয়েক বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ছেড়ে চলে যাওয়া, আবার নতুন করে গড়ে তোলা, তারপর আবার ভাঙন, আবার নতুন এক দল প্রতিষ্ঠা, এইভাবেই তো চলেছিল তাঁর কর্মজীবন।

১৯৫৮ তে গণনাট্যে যুক্ত থাকাকালীন ‘চার অধ্যায়’-এর নাট্যরূপ দিতে চাওয়া বছর পঁচিশের তরুণটিকে হতাশ হতে হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শের সীমাবদ্ধতায়। রক্ষণশীল সাম্যবাদীরা তখনও বিশ্বাস করতেন, রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল। ‘চার অধ্যায়’-এ সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে যে দূরদর্শিতা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চোখ তৈরি হয়নি তাঁদের। গণনাট্য সংঘ থেকে শীঘ্রই বেরিয়ে এসেছিলেন অজিতেশ। তারপর ১৯৬০-এ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন মিত্র, অজয় গঙ্গোপাধ্যায়, মহেশ সিংহ, রাধারমণ তপাদার, চিন্ময় রায়দের নিয়ে ‘নান্দীকার’। পরের বছর যোগ দিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। অজিতেশের সঙ্গে রুদ্রপ্রসাদের বন্ধুত্ব সেই মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের কমন রুম থেকে। সেই বন্ধুত্ব গড়িয়েছিল একসঙ্গে ঘরভাড়া নেওয়া অবধি।

রুদ্রপ্রসাদকে খোকন বলে ডাকতেন অজিতেশ। পড়াশোনার তুখোড় খোকন তখন স্কটিশচার্চে উচ্চশিক্ষা করছেন। এক বন্ধুর সঙ্গে নোবেলজয়ী ইতালিয়ান নাট্যকার লুইগি পিরানদেল্লোর ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’-এর বঙ্গীয়করণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চস্থ করার সুযোগ পাননি। অজিতেশ সেই চিত্রনাট্য পড়েছিলেন সারারাত ধরে। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’ নান্দীকারকে যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, তারপর আর জনপ্রিয়তা নিয়ে তেমন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। কিন্তু পিরানদেল্লোর ফ্যাসিস্ট-সংযোগ তৎকালীন বঙ্গের বামধর্মী আবহাওয়ায় উস্কে দিয়েছিল বিতর্কও। স্বয়ং উৎপল দত্ত নাটকটিকে বয়কট করেছিলেন। কিন্তু সেই বিতর্কই উল্টে দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে আকৃষ্ট করে। সিনেমা হলের সামনে মানুষের মধ্যে লিফলেট বিলি করতেন অজিতেশ ও অসিত। আর তার পরের নাটক ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ (আন্তন চেখভের ‘চেরি অর্চার্ড’-এর বাংলা নাট্যরূপ) তো নান্দীকারকে বাংলা নাট্যজগতে বিদেশি নাটকের বঙ্গীয়করণের ক্ষেত্রে সুউচ্চ আসন দিয়েছিল। নিন্দুকদের অভিযোগও ছিল, নান্দীকার কেবল বিদেশ-নির্ভর নাটক ছাড়া করতে পারে না। অজিতেশের সাফ বক্তব্য-‘বিদেশ থেকে নেওয়া এই নাট্য-অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের নাট্যজগতে নতুন কোনও বোধের দিকে নতুন কোনও পরীক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না কি? নিছক অনুবাদেই থমকে না থেকে যদি তাকে মিলিয়ে দেওয়া যায় নিজেদেরই প্রতিবেশীর মধ্যে?’

ছ’বছরের মধ্যেই বারোজন শিল্পী বেরিয়ে গিয়েছিলেন দল থেকে। যোগ্য পরিবর্ত নেই। কতকগুলো একাঙ্কিকার পর ‘শের আফগান’ মঞ্চস্থ হল মাত্র বারোটা মহড়ায়। নকশাল আন্দোলনের গনগনে পরিস্থিতিতেও টিকিট বিক্রির জন্য ধুম পড়ে গিয়েছিল। মঞ্চে ফিরে এল সুপারহিট ‘যখন একা’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’। একে একে ‘তিন পয়সার পালা’, ‘হে সময়, উত্তাল সময়’, ‘বিতংশ’। আবার নিজেদের জাত চেনাতে আরম্ভ করেছিল অজিতেশের দল। পরীক্ষা-প্রিয়, লড়াকু, ক্ষণজন্মা, স্বল্পায়ু অভিনেতাটিকে তাই নাটকের দর্শক চিরকাল মনে রেখে দেবে, এ আর অস্বাভাবিক কী!

কিন্তু নাটকের বাইরে চলচ্চিত্র ও বেতার-নাটকেও যে মুন্সিয়ানা তিনি দেখিয়েছিলেন, তা যেন তাঁকে কেবলমাত্র অভিনেতা নয়, একজন অভিনয়শিল্পী হিসাবে পূর্ণতা দিয়েছিল। এমনকি যাত্রার জগতেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তবে, যাত্রার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এখানে আরও একজন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলতে হয়। কারণ, দুই অজিতের (কলেজের খাতায় অজিতেশের নাম ছিল অজিত) মধ্যেই নাম ছাড়া আরও বেশ কিছু মিল রয়েছে। দুজনেরই জন্মদিন সেপ্টেম্বর মাসে। অজিতের ২৭, অজিতেশের ৩০। দুজনেরই প্রিয় ক্ষেত্র ছিল মঞ্চাভিনয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় মিল হল, দুজনের কেউই যাত্রার অতি-অভিনয়ে যেতে চাননি।

আমি যাত্রায় এসেছি যাত্রার অভিনয়ের ধারাটিকে বদলে দেবার জন্যে

লোভনীয় বেতন সত্ত্বেও অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় তো কোনোদিন ও পথই মাড়াননি। অজিতেশও মাত্র দুই থেকে তিন বছরের জন্য যাত্রার জগতে প্রবেশ করে আবারও নিজের জগতে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম যে বছর তিনি যাত্রায় যোগ দেন, সেবছর মেদিনীপুরের একটি গঞ্জে ‘রাবণ’ পালায় রাবণের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন তিনি। পালার শেষে মাঝরাতে মেক-আপ তুলছেন, এক ভদ্রলোক এসে তাঁকে বলেছিলেন, রাবণের পালা তাঁর যাচ্ছেতাই লেগেছে, অজিতেশ যেন সত্বর নামকরা যাত্রাভিনেতা মোহন চট্টোপাধ্যায়ের থেকে যাত্রার অভিনয় শিখে আসেন। আপাদমস্তক ভদ্রলোক অজিতেশ তাঁর কথায় এতটুকু না রেগে গিয়ে তাঁকে দশ-বারো রকমের হাসি হেসে দেখিয়ে তারপর জিজ্ঞাসা করেন - ‘এইরকম হাসি হলে চলবে আপনার?’ হতভম্ব লোকটি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এতরকম জানা সত্ত্বেও তিনি অভিনয়ে তা দেখালেন না কেন, অজিতেশ তাঁকে বলেন - ‘এসব ম্যাজিক আমি জানি। কিন্তু করব না। আমি যাত্রায় এসেছি যাত্রার অভিনয়ের ধারাটিকে বদলে দেবার জন্যে। সুতরাং আমি আমার মতোই অভিনয় করব।’ কারণ, অজিতেশের যুক্তি ছিল, সময় বদলাচ্ছে, যে জিনিস একশো বছর আগে ছিল, তা আর এখন চলতে পারে না। অজিতেশের এমন চাঁচাছোলা যুক্তির পর আর কথা বলতে পারেননি ভদ্রলোক।

না, যাত্রার ধারা অজিতেশ বদলাতে পারেননি। তাঁকে নিজেকেই সরে আসতে হয়েছিল যাত্রার পৃথিবী থেকে। কিন্তু তাঁর আপসহীন ব্যক্তিত্বের সার্থক পরিস্ফুটন এই ঘটনায় অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে এক্ষেত্রে হয়ত বলতে হবে তাঁর লেখাদের কথাও। যে মানুষের কলম থেকে উদ্ধত চাবুক বেরিয়ে আসে - ‘দেশের প্রায় সবাই এখন সাদাপোশাকে ঘুরছে/লাথি খেয়ে বলছে/তবু তো প্রাণটা রক্ষে পাচ্ছে/ধীরে ধীরে এ লাথিও অভ্যাস হয়ে যাবে।’, আবার সেই তিনিই লিখে ফেলেন - ‘রেল লাইনের প্রত্যেকটি পাথর আমার শৈশব।/কোনটা সেজকাকার বকুনি, কোনটা বা রমার চোখ/কোনটা মায়ের কড়ি আঙুল, বন্ধুর মুখ থেকে শোনা/প্রথম অশ্লীল শব্দ বা।’ আসলে, দীর্ঘদেহী মানুষটির ব্যক্তিত্বের বিশালত্ব তাঁকে কখনও থেমে যেতে শেখায়নি।

১৯৮৩-র ১৪ই অক্টোবরের মধ্যরাত। দুর্গাষ্টমীর উৎসবমুখর কলকাতা। সপ্তমীর সন্ধেয় সুজাতা সদনে ‘এই অরণ্যে’-র দুটো শো করে বাড়ি ফিরে নৈশভোজ সেরেছিলেন। বুকের যন্ত্রণার পর কয়েকটা মিনিট। অকালবোধনের অষ্টমীর রাত বড় অকালেই যেন টেনে নিয়েছিল সদ্য পঞ্চাশ-অতিক্রান্ত তাঁকে। ওই বোধহয় একবারই থেমেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More