সুন্দরবনের লবণাক্ত মাটিও ধান চাষের উপযোগী, ভরসা দিচ্ছেন বাঙালি গবেষকরাই

কোথাও কোমর অবধি জল। আবার কোথাও জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গেছে আস্ত মাটির বাড়ি। ইয়াস পরবর্তী সুন্দরবনের ছবি ছিল এমনটাই। দু’সপ্তাহ পেরিয়ে এসে খানিকটা হলেও পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে সুন্দরবন। নেমেছে জলস্তরও। কিন্তু কৃষিনির্ভর অঞ্চলটার মেরুদণ্ডই যেন গুঁড়িয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে। বিঘার পর বিঘা ধানক্ষেত— কিছুই আর চাষযোগ্য নেই। সমুদ্রের লবণাক্ত জল ঢুকে পড়ায় হারিয়েছে মাটির গুণগত মান। আগামী দু-আড়াই বছরও যে এই জমিতে ফসল ফলানো বেশ দুষ্কর— তা শুরু থেকেই শোনা যাচ্ছিল কৃষকদের মুখে। কিন্তু এই অবস্থাতেও আশার আলো দেখাচ্ছেন বাঙালি গবেষকরা। জানাচ্ছেন উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে আবারও সবুজ-সুফলা হয়ে উঠতে পারে সুন্দরবন।

প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে স্বাস্থ্য ফিরবে লবণাক্ত মাটির? এই উত্তর পেতে কারণ খুঁজতে হবে মূল সমস্যার। তা হল সমুদ্রের লবণাক্ত জলের উপস্থিতি। সামুদ্রিক লবণে উপস্থিত সোডিয়াম আয়নই মূলত কমিয়ে আনে মাটির ফলনশক্তি। মাটির অণুর সঙ্গে এই আয়নের বন্ধনের কারণে বেড়ে যায় মাটির পরিবাহিতা। তার মাত্রা ০.৯৯-এর বেশি হলেই, তা প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় বীজের অঙ্কুরোদগমে। এখন পুনরায় এই মাটিকে চাষযোগ্য করে তোলার একমাত্র উপায় হল, সোডিয়াম আয়নগুলিকে সেখান থেকে ছেঁকে বার করা। 

“সোডিয়ামকে মাটি থেকে পৃথক করতে মূলত জিপসাম ব্যবহার করি আমরা। জিপসামের ক্যালসিয়াম আয়ন সোডিয়াম আয়নকে প্রতিস্থাপিত করায় মাটির পরিবাহিতা হ্রাস পায়। পাশাপাশি মাটির অণুগুলিকে এই ক্যালসিয়াম সঙ্গবদ্ধ রাখতেও সাহায্য করে। এরপর ধানের তুষ এবং তুষ পোড়া যদি মাটির সঙ্গে মেশানো যায়, তবে জলীয় দ্রবণ থেকে বাড়তি সোডিয়াম কণাগুলিকে ছেঁকে বার করা আনা সম্ভব।”

বলছিলেন ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক কৌশিক মজুমদার। তবে এই প্রক্রিয়াও খানিক দীর্ঘমেয়াদি। ফলে একদিনেই চেহারা ফিরবে না মাটির। সময় লাগতে পারে বছর খানেকের মতো। তবে তার আগে কি আর কোনোভাবেই চাষ সম্ভব নয় লবণাক্ত মাটিতে? সেই সমস্যার সমাধানও দিয়েছেন বাঙালি গবেষকরা। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে সাধারণ আমন, আউশ কিংবা বোরো ধান রোপণ করা যাবে না এই জমিতে। কিন্তু লবণাক্ত মাটিতে সহনশীল বিশেষ কিছু ধান চাষ করা সম্ভব।

আরও পড়ুন
পূর্বাভাস ছিল না ইয়াস-পরবর্তী জোয়ারের, বিধ্বস্ত সুন্দরবনের ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ প্রণবেশ

“একশো শতাংশ নোনা সহনশীল ধান প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মাটির পরিবাহিতার মাত্রা বা ইসি লেভেল ৫ থাকলেও বিশেষ কিছু প্রজাতির ধানের চাষ সম্ভব। জারাভা, লুনা শ্রী, পোখরালি এই ধরনের বীজ রোপণ করতে পারেন কৃষকরা। তার পারফর্মেন্স ৫০ শতাংশও যদি হয়, কিছুটা হলেও ফলন পাওয়া যাবে”, বলছিলেন ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট বোটানিস্ট সুমিত মুর্মু। 

আরও পড়ুন
ইতিহাসের সলিলসমাধি, ইয়াসের তাণ্ডবে নিশ্চিহ্ন ফ্রেজার সাহেবের বাংলোও

এছাড়াও ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের গোসাবা উপকেন্দ্রে ক্রসব্রিডিং-এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে আরও দুটি ধানের প্রজাতি। যা ইতিমধ্যেই ছাড়পত্র পেয়েছে জাতীয় স্তর থেকে। বাংলায় তৈরি এই দুটি ব্রিডও হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে লবণাক্ত মাটিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে। 

আরও পড়ুন
ক্ষয়ক্ষতিতে আয়লা-আমফানকেও ছাপাল ইয়াস? আশঙ্কা সুন্দরবনকে ঘিরে

তবে সতর্ক করলেন সুমিতবাবু, “এই মুহূর্তে পছন্দ মতো বিশেষ কোনো প্রজাতির ধান রোপণ করা ঠিক নয়। আগে জমির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তারপর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই চারা বসাতে হবে কৃষকদের। জমির ইসি লেভেলের ওপর নির্ভর করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে একাধিক প্রজাতির ধানের চাষ করেও দেখতে পারেন কৃষকরা। প্রথমবারের ফলনই জানান দেবে কোন প্রজাতির ধানটা সবথেকে বেশি উপযোগী ওই জমির জন্য।” 

ইতিমধ্যেই একাধিক লবণ সহনশীল ধানের বীজ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি খামারে। খুব শীঘ্রই শুরু হতে চলেছে মাটি থেকে লবণ পৃথকীকরণের প্রক্রিয়াও। সেইসঙ্গে বর্ষার আগমনও খানিকটা স্বাভাবিক করে তুলতে পারে পরিস্থিতিকে। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ের আঘাত থেকে সুন্দরবনকে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখাচ্ছেন বাংলার গবেষকরা… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More