আমার মনে হয়, অকাল আষাঢ় যখন সকালবেলায় ঝলোমলো হয়ে ঘনকালো আকাশে বাজতে থাকে, আর বাদলের প্রথম কদম ফুল ফুটে ওঠে বনে বনে, তেমনি একটি দিনেই ঋতুর জানালা দিয়ে দূরে একমনে চেয়ে থাকার দিন। ঋতু মানে ঋতুপর্ণ ঘোষ।
ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালিত ছবিতে, লেখায়, গানে, অভিনয়ে নরম যত্নের আভাস পাই আমি। যেন এক আবহমান বাংলার মা পরম যত্নে কর্পূর মেশানো জল রাখা গেলাসের আলপনা আঁকা ঢাকনা; তালপাখার পাশে সাজিয়ে রাখছেন।
'দরদ' শব্দটির জ্যান্ত মানুষরূপ মনে হয় ঋতুকে।
প্রতিদিনের ব্যঙ্গ, অপমান, ছিটিয়ে দেওয়া রক্তথুতুর ভিতর দিয়ে যেতে যেতেও নিজেকে নিজেই আগলে রেখেছেন তিনি। প্রবল কান্নার সময় নিজের কাঁধে নিজেই হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন আগল ভাঙার আলো।
পুরুষদেহের ভিতরে থাকা এক নারীমনের প্রকাশ অথবা নারীদেহের ভিতরে থাকা পুরুষমনের প্রকাশকে সমাজ চিরকাল চেপে দিতে চেয়েছে জুতোর তলায়।তাঁর অনুভূতি, আনন্দ, পোশাক, যৌনতা দেখে সমাজ আরশোলাকেন্নোজ্ঞানে ওয়াক তুলেছে, পিটিয়ে পিটিয়ে বেড়ার ওধারে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাকিয়ে থেকেছে ঠান্ডা-শীতল সার্কাস দেখার কৌতুক চোখে। ঋতু এই দুয়ারে এসে নাড়া দিয়েছে।
আজ অনেককেই এই ভাঙাপথের রাঙাধূলার পথে হেঁটে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছেন তিনি।
নিজের যাপিত জীবনে প্রেম-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া, যন্ত্রণা, অশ্রুবেদন ছবির ভিতর বয়ে বয়ে গেছে।
সতীর মৃত্যুর পর চক্রআঘাতে দেহ যেমন ছড়িয়ে মিশে গিয়েছিল, তেমনি ঋতুর নারীমন প্রতিটি ছবির নারীচরিত্রের ভিতর ফুটে ওঠে। অমন সূক্ষ্মতায় খুঁটিনাটিসহ ছবিতে সমস্ত চরিত্রদের সৃষ্টি, কল্পনা করা যায় না।
অল্পপরিসরে সমস্ত ছবি নিয়ে কথা বলা অসম্ভব। আমি একটি ছবির কথা বলছি, 'বাড়িওয়ালি'। শুরুর দৃশ্যে প্রাচীন মন্দিরের জানালায় মুখ করে দাঁড়িয়ে কথা বললে যে গুমগুম শব্দ হয় সেটি খেয়াল রাখা, মঙ্গলকাব্যের বেহুলাসুন্দরীর লখাইমরণকে এইসময়ের এক বিগতযৌবনা নারীর ভিতর মিলিয়ে দেওয়া, প্রসন্ন চরিত্রটির লিঙ্গচেতনা গুলিয়ে দেওয়া, ওইসব আশ্চর্য স্বপ্নদৃশ্য নির্মাণ, বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে দেওয়ার ভিতর দিয়ে অমন যৌনতার কথা বলা – এ-ঋতুপর্ণ ঘোষের দ্বারাই সম্ভব।
মনে হয়, ঋতুর পৃথিবীতে চলে যাওয়া আসলে যাওয়া নয়, বর্ষার অভিসার রাতে শাঙন মাসের ঘনজল বনগন্ধের মাধবকুঞ্জের দিকে যাত্রা। সেখানে নীল শাড়ি, জলভেজা ফুল, রাধিকানূপুর...
Powered by Froala Editor