নাতনির জন্য পপ-আপ বই, নজির কলকাতার প্রবীণ ভূবিজ্ঞানীর

পাতা উল্টোলেই বই-এর ভাঁজ থেকে উঠে আসবে বেড়ালের তালব্য-শ কিংবা গেছোদাদার প্রতিকৃতি, কখনও আবার উঠে দাঁড়াবে কলসি-হাঁড়ি বোঝাই গরুর গাড়ি। পেঙ্গুইন কিংবা অন্যান্য বিদেশি প্রকাশন থেকে হামেশাই প্রকাশিত হয় এ-হেন শিশুপাঠ্য ত্রিমাত্রিক সাহিত্যের বই, যা পরিচিত পপ-আপ বুক (Pop-Up Book) নামে। তবে বাংলা সাহিত্যে এ-জিনিস ব্রাত্য ছিল এতদিন। এবার সেই অভাব পূরণ করে দিলেন কলকাতানিবাসী প্রদীপ সেনগুপ্ত (Pradip Sengupta)। 

৭৫ বছর বয়সি প্রদীপবাবু পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত ভূতাত্ত্বিক (Geologist)। হ্যাঁ, খানিক অবাক লাগাই স্বাভাবিক। ভূতত্ত্ব থেকে সোজা বই প্রকাশনা! তাও কি সম্ভব? হ্যাঁ, তেমনটাই সম্ভব করে দেখিয়েছেন তিনি। তবে বাজারে বই প্রকাশ করে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার লক্ষ্য ছিল না তাঁর কোনোদিনই। তাঁর তৈরি এই অবাক গ্রন্থের পাঠক একজনই— তাঁর ৬ বছর বয়সি নাতনি।

বছর চারেক আগের কথা। ২০১৭ সালের শেষের দিক সেটা। নাতনির জন্য বই খুঁজতে দোকানে হাজির হয়েছিলেন প্রদীপবাবু। তবে সেখানে গিয়ে বেশ অবাকই হতে হয় তাঁকে। প্রথমত, ছোটোবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা সুকুমারের যে-সব বই পড়েছিলেন তিনি, তাতে সাদা-কালো ছবি থাকলেও, তা ছিল লেখার সঙ্গে যথেষ্ট সাযুজ্যপূর্ণ। বর্তমানে অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থাই যে-ছবি ছাপায়, তা রঙিন হলেও লেখার বিষয়ের সঙ্গে খুব একটা মিল নেই তাদের। পাশাপাশি বানান-ভুলের বহর তো আছেই। অবশ্য গুণমানের দিক থেকে ভালো কিছু বই এমনকি তবে পপ-আপ বই-ও বাংলাদেশ থেকে আমদানি হয় এই শহরে। তবে তার বিষয়বস্তু বিদেশি বই-এর অনুকরণে তৈরি। তাই নিজেই এই ধরনের বই তৈরির পরিকল্পনা করেন অবসরপ্রাপ্ত ভূতাত্ত্বিক। 

যেমন পরিকল্পনা, তেমনই কাজ। কীভাবে পপ-আপ বই তৈরি করতে হয়, কীভাবে বানানো সম্ভব অরিগ্যামি কিংবা কোন কাগজের ব্যবহার করতে হয়— ইউটিউব থেকেই তার প্রশিক্ষণ নেন প্রদীপবাবু। তারপর হাত লাগান কাজে। ২০১৮ সালে শেষ হয় তার প্রথম কাজ। শিশু সাহিত্য সংসদের প্রকাশিত ছড়ার বইটিকে তিনি নিজস্ব কেরামতিতে বানিয়ে ফেলেন ত্রিমাত্রিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থ তৈরির জন্য অনেক সময় বিভিন্ন বই-এ প্রকাশিত ছবিকে ত্রিমাত্রিক ছবিতে রূপান্তরিত করতে হয়েছে, কখনও আবার নিজেকেই আঁকতে হয়েছে ছবি। তবে পেশার সূত্রে ফটোশপের কাজ জানতেনই, ফলে অসুবিধা হয়নি খুব একটা।

আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডের বুকে স্বাধীন 'বইয়ের দেশ'! সাড়া ফেলেছিলেন বই-ব্যবসায়ী

ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,

আরও পড়ুন
যুদ্ধের স্মৃতি থেকে মুক্তি দিতে বই-থেরাপি সিরিয়ায়

চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি !

আরও পড়ুন
দেবেশ রায়ের বই ও একটি 'কেতাব-ই' সন্ধ্যা

 

এর পর ২০১৮-১৯ সালে তিনি তৈরি করেন সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-এর পপ-আপ সংস্করণ। রবীন্দ্রনাথের ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’-ও ত্রিমাত্রিকতার ছোঁয়া পেয়েছে তাঁর সৌজন্য। তবে সমস্যা একটাই। প্রদীপবাবুর অভিমত, এইসব গ্রন্থ প্রকাশযোগ্য নয়। কারণ, এক একটি গ্রন্থ তৈরিতেই তাঁর খরচ হয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ফলে, সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন গ্রন্থ সচরাচর সাধ্যের বাইরে। তবে তা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন তিনি। কেননা, তাঁর একমাত্র পাঠক, তাঁর নাতনি বেজায় খুশি এইসব বই পেয়ে। সেখান থেকেই ছড়া পড়ে নাতনিকে ঘুম পাড়ান প্রবীণ ভূতাত্ত্বিক। 

তবে এখানেই শেষ নয়। আরও একটি চমকপ্রদ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জুড়ে রয়েছেন প্রদীপবাবু। সেটা অবশ্য সম্পূর্ণভাবে নাতনির জন্য নয়, বরং এটাকে তাঁর নেশা বলাই চলে। অবসর সময়ে মানচিত্র নির্মাণ করেন প্রদীপবাবু। যে-সব শহরের নকশা তৈরি করেন তিনি, বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নেই কোনো। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। সত্যজিতের সোনার কেল্লার ম্যাপ কিংবা বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়— তাঁর উদ্যোগ থেকে বাদ পড়েনি কোনোটাই। তাছাড়া গল্পের ওপর ভিত্তি করেও পপ-আপ বই তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বিষয় ছিল, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কালজয়ী চরিত্রও ঘনাদার গল্প। তবে মধ্যবর্তী সময়ে মহামারীর কারণে সেই কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন। এদিকে বায়না বেড়েছে নাতনিরও। তাই নতুন উদ্যমেই ফের তিনি শুরু করতে চলেছে এই অবাক-গ্রন্থ তৈরির কাজ। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ‘ঘনাদা ক্লাব’-ও। হয়তো আগামীদিনে তাঁদের সৌজন্যেই মুদ্রিত আকারেও প্রকাশিত হতে পারে প্রদীপ সেনগুপ্তের এই কাজ…

ছবি ঋণ - প্রদীপ সেনগুপ্ত, ফেসবুক

Powered by Froala Editor

More From Author See More