দেবেশ রায়ের বই ও একটি 'কেতাব-ই' সন্ধ্যা

“লেখকের কাজ সাহিত্যের ভিতর দিয়ে নিজেকে অ্যাবস্টেনসিয়েট করা।” দেবেশ রায়ের সাক্ষাৎকার থেকে এই বিশেষ লাইনটিকেই তুলে নিয়ে আসা হল ‘চাপান-ওতোর’ নামক বইটির কলারে। দেবেশ রায়ের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে ২ বছরেরও বেশি সময়। এই সময়ের মধ্যে আরও একাধিক নক্ষত্রপতনের সাক্ষী থেকেছে বাংলা সাহিত্য জগত। তবে দেবেশ রায়ের স্মৃতিতে এই প্রথম কলকাতার বুকে আয়োজিত হল বিশেষ স্মরণসভা। প্রকাশিত হল তাঁর সাক্ষাৎকারের সংকলন ‘চাপান-ওতোর’ এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা পর্যালোচনার সংকলন ‘পড়া-দেখা-শোনা’। বইদুটির প্রস্তুতি থেকে শুরু করে তাকে মলাটবন্দি করে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ দায়িত্বটাই নিয়েছে ‘কেতাব-ই’।

বাংলা সাহিত্যের জগতে এক ভিন্নধর্মী লক্ষ্যকে সামনে রেখে পথচলা শুরু ‘কেতাব-ই’-র। নামের মধ্যেই সেই উদ্দেশ্য পরিষ্কার। মলাটবন্দি কাগজে ছাপা অক্ষর থেকে বইকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল মাধ্যমে নিয়ে আসাই ছিল ‘কেতাব-ই’-র প্রাথমিক লক্ষ্য। অথচ ১৭ জুলাই রোটারি সদনের অনুষ্ঠানে দেবেশ রায়ের লেখার দুটি সংকলন সহ প্রকাশ পেল মোট ৬টি বই। এবং সেগুলি সবই মলাটবন্দি রূপে। কেন? ‘কেতাব-ই’-র পক্ষ থেকে সেই উত্তর দিলেন তাপস দাস। তাঁর কথায়, “ছাপা বইয়ের বাজার এবং ডিজিটাল বইয়ের বাজার যে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এটা প্রমাণ করার দায় আমাদের থেকেই যায়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যের বাজারের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, তাকে শুধুমাত্র আধুনিকতার দায় থেকে নষ্ট করে ফেলা যায় না।”

“আসলে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি ডিজিটাল বই বিকল্প শুধু নয়, পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে।” বলছিলেন ‘কেতাব-ই’-র কর্ণধার পিনাকী মিত্র। অবশ্য এতদিন ই-বই তৈরির বিকল্প উদ্যোগেই মূলত সীমাবদ্ধ থেকেছে ‘কেতাব-ই’। এবার ক্রমশ পরিপূরক হয়ে ওঠার তাগিদ থেকেই ১৭ জুলাই ‘সাত-১৭’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে উদ্বোধন করা হল একটি ডিজিটাল লাইব্রেরির। শুধু বই নয়, একইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ছোটো পত্রিকারও একটি সংগ্রহশালা হয়ে উঠতে চায় এই লাইব্রেরিটি। উদ্বোধনের মুহূর্তেই সেখানে জায়গা পেল ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকার ১৯৮০ সালের প্রথম সংখ্যা।

ভার্চুয়াল লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধ

 পিনাকী বলছিলেন, “শুধুমাত্র আর্কাইভ করে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। একইসঙ্গে বই ও পত্রিকাগুলির পাঠ-অভিজ্ঞতার উন্নতি ঘটানোও আমাদের উদ্দেশ্য। বলা ভালো সেটাই আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।” আন্তর্জাতিক স্তরে এই কাজ আমাজন কিন্ডল বা গুগল বুকসের মতো সংস্থা করে চলেছে। কিন্তু বাংলা ভাষার বই নিয়ে তাঁরা এখনও আগ্রহী নন। তাপস দাসের কথায়, “আমরা এটা বলে বসে থাকতে পারি না যে অন্যেরা করছেন না। বাংলা সাহিত্যের জন্য এটুকু করা আমাদের নিজেদের দায়িত্ব।” আর সেই কারণেই প্রযুক্তি থেকে সাহিত্য জগতের মানুষদের একসঙ্গে জুড়ে নিয়ে এই বিরাট আয়োজন শুরু করেছেন তাঁরা।

পিনাকী বলছিলেন, “ই-বই মানে চোরাই পিডিএফ নয়। বরং বই পড়ার এক সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধ্যম। সেটাই আমরা বোঝাতে চেয়েছি। অবশ্য নতুন এই ব্যবস্থায় নানা ত্রুটি থাকবেই, প্রযুক্তিগত সমস্যাও থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ তাকে নির্ভুল করে তুলতে হবে। আর সবটাই সম্ভব হবে প্রকাশক থেকে শুরু করে পাঠকরা আমাদের সঙ্গে থাকলে।” তাঁর কথায় উঠে এল এর প্রয়োজনীয়তার দিকটিও। বললেন, “প্রবাসী বাঙালি হিসাবে আমি বারবার বুঝেছি, অন্য দেশে বসে বাংলা বই সংগ্রহ করা কতটা সমস্যার। ই-বই এই সমস্যা দূর করতে পারে। তাছাড়া বই ছাপার খরচ না থাকায় ই-বইয়ের দামও ছাপা বইয়ের অন্তত অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু তার মানে ই-বই দিয়ে আমরা ছাপা বইয়ের বাজারকে নষ্ট করতে চাইছি, এটা একেবারেই নয়। বর্তমানে অনেকেই বাড়িতে জায়গার অভাবে বই কিনতে পারেন না। ই-বই সেই সমস্যারও সমাধান করতে পারে।” ফলে সামগ্রিকভাবে বই বিক্রি বাড়বে বলেই বিশ্বাস করেন পিনাকী-তাপসরা।

বইয়ের বিপণন সংক্রান্ত এই ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি এক মননশীল সাহিত্য পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েও এগিয়ে চলেছে ‘কেতাব-ই’। আর এই পথচলায় ইতিমধ্যেই পাশে পেয়েছেন অনেকে। রোটারি সদনের অনুষ্ঠানে উঠে এল সেইসব উদ্যোগের নজিরও। মে মাসে ‘কেতাব-ই’-র পক্ষ থেকে তরুণদের কাছে গল্প পাঠানোর আবেদন করা হয়েছিল। জমা পড়ে প্রায় ১৫০টির বেশি গল্প। তার মধ্যে থেকে ১৫টি গল্পকে বেছে নিয়েছেন সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত, যশোধরা রায়চৌধুরী এবং দেবতোষ দাস। নির্বাচিত ১৫টি গল্পকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশের উদ্যোগও শুরু হল এ-দিনের অনুষ্ঠান থেকে।

নির্বাচিত লেখকদের সম্মাননা জ্ঞাপন

 এ-দিনের অনুষ্ঠানেই প্রকাশিত হল ৬টি ছাপা বই। দেবেশ রায়ের লেখা ও সাক্ষাৎকারের সংকলগুলি ছাড়াও প্রকাশিত হল দেবতোষ দাসের ‘বিন্দুবিসর্গ’, ইন্দুভূষণ মণ্ডল সম্পাদিত ‘নারী বাউল’, উৎসা রায়ের ‘মৃণালিনী’ এবং রানা সরকারের ‘পথের নতুন কাঁটা’। বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রতিটি বই-ই ভিন্ন স্বাদের। ‘বিন্দুবিসর্গ’ উপন্যাসে রহস্যের সঙ্গে মিলেমিশে যায় ভারতবর্ষের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বর্তমান সময়ের বিকৃত ইতিহাস রচনার প্রবণতাও। আবার ইন্দুভূষণ মণ্ডল এবং উৎসা রায়ের বইদুটিতে উঠে এসেছে সমাজে নারীর অবস্থানের কথা। রানা সরকারের প্রথম উপন্যাস ‘পথের নতুন কাঁটা’। এই রহস্যগল্পটিতে লেখক ধরতে চেয়েছেন ব্যোমকেশ বক্সীর ‘পথের কাঁটা’ গল্পে যুক্তির দুর্বলতার দিকগুলি। এবং সেইসঙ্গে সেই কাহিনিকে বিনির্মাণ করে গড়ে তুলেছেন নতুন একটি কাহিনি। প্রতিটি বই-ই যে যথেষ্ট পরীক্ষামূলক, সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আর সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে এই পরীক্ষামূলক কাজে এগিয়ে এসেছে ‘কেতাব-ই’।

দেবেশ রায়ের দুটি সংকলনের প্রকাশ

 তবে এ-দিনের অনুষ্ঠানে অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল দেবেশ রায়ের স্মৃতিতে আয়োজিত আলোচনাসভা ‘দেবেশ রায়ের বিস্তার’। আলোচনার শুরুতেই তাপস দাস বললেন, “এই আলোচনাসভা শোকপ্রকাশের জায়গা নয়। স্মৃতিকথনের মঞ্চও নয়। বরং দেবেশ রায়ের লেখাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তাঁর পাঠকগোষ্ঠীকে জাগিয়ে রাখাই আমাদের উদ্দেশ্য।” সেই সূত্র ধরেই প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে এগিয়ে চলল আলোচনা। সমরেশ রায়ের কথায় উঠে এল নানা পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা লেখাগুলিকে সংকলিত করার নানা জটিলতার কথা। বললেন, “১৯৬০ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রথম পর্যালোচনা লেখেন তিনি। সেটি ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে। এরপর নানা সময়ে নানাভাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কতটা পরিবর্তন ঘটেছে, বা আদৌ ঘটেছে কিনা – তাও আলোচনার দাবি রাখে।”

রুশতী সেনের বক্তব্যে উঠে এল দেবেশ রায়ের উপন্যাসের ব্যতিক্রমী চরিত্রগুলির কথা। স্মৃতি থেকে ফিরে এল দেবেশ রায়ের কথা। “পাঠক যদি কোনো লেখককে প্রত্যাখ্যান করতে না পারেন, তবে তিনি প্রকৃত পাঠক নন। আবার কোনো লেখক যদি পাঠককে প্রত্যাখ্যান করতে না পারেন, তবে তিনি প্রকৃত লেখক নন।” এই প্রত্যাখ্যান অবশ্য শুধু পাঠক বা লেখকের প্রতি নয়। কখনও কাহিনির প্রতি, আবার কখনও চরিত্রের প্রতিও। ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’-এর উল্লেখ করে রুশতী সেন দেখালেন কাহিনির ভিতরের মিথ্যাভাসকে কত সহজ স্বীকারোক্তিতে তুলে ধরতে পারতেন দেবেশ রায়। স্বীকার করে নিতেন, কালি-কলমের ব্যবহার জানা মানুষের অজ্ঞেয় জগতকে নিয়ে যতই লেখা হবে ততই মিথ্যে কথা লেখা হবে।

চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কথায় উঠে এল পর্যালোচক দেবেশ রায়ের কথাও। স্বপন পাণ্ডা, গৌতম সেনগুপ্ত আলোচনা করলেন দেবেশ রায়ের সাহিত্য দর্শনের নানা দিক নিয়ে। সেই দর্শনের উপযুক্ত চর্চা হয়নি কোনোদিনই। অথচ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যেন ক্রমশ প্রতিবর্ততায় ভর করে পৌঁছে গিয়েছে কিছু শব্দবন্ধ। অন্যদিকে নীরবে এক নতুন নির্মাণকে সৃজিত করে চলেছিলেন দেবেশ রায়। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে এই কাজ করছিলেন, যখন সাহিত্যের সত্য বিপন্ন হয়েছে। বাস্তব জগত ক্রমশ তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। যুক্তিও বিপন্ন হচ্ছে। অথচ এই বিপন্নতার ভিতর দিয়েই প্রকাশ ঘটছে এক নতুন সত্যের। দেবেশ রায়ের আরও নানা পর্যালোচনা-কে সংগ্রহ করে সেই নতুন সত্যের ইঙ্গিতকে আরও সুস্পষ্টভাবে ধরে রাখার কাজটি করবে ‘কেতাব-ই’ এই আশাটুকু করাই যায়। সেইসঙ্গে অবশ্যই আশা রাখতে হয়, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও সফল হবে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More