খোদ পশ্চিমবঙ্গেই বিলুপ্তির মুখে এই ১০টি ভাষা, দায়ী বাংলার আধিপত্য

/১০

ধুলিয়া, তামাং, সাঁওতালি, শবর, টোটো, মুন্ডা— পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন অসংখ্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। রয়েছে তাঁদের পৃথক পৃথক ভাষাও। একেবারেই তাকে বাংলার উপভাষা বলা চলে না। প্রতিটিরই রয়েছে স্বাধীন, স্বতন্ত্র ব্যকরণ এবং শব্দভাণ্ডার। তবে পশ্চিমবঙ্গের বুকে দাঁড়িয়ে বাংলার আড়ালে কোথাও যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এইসব ভাষা। যেখানে প্রতিদিন দাবি ওঠে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরে বিপন্নতার দিকেই এগিয়ে চলেছে বাংলা। ঠিক সেই জায়গা থেকেই বাংলা নিজে এই আঞ্চলিক ভাষাদের বিপন্নতার কারণ।

/১০

বিরহোড় ভাষা— বিরহোড় একটি অবলুপ্তপ্রায় মুন্ডা ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে চল রয়েছে এই ভাষার। তাছাড়াও ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা ও মহারাষ্ট্রে এই ভাষার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে গোটা ভারতে এই ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র দেড় হাজার। স্কুল, কলেজে এই ভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকলেও প্রতিটি বিরহোড় পরিবারেই সন্তানদের ছোট থেকেই শেখানো হয় এই ভাষা।

/১০

টোটো ভাষা— এই ভাষার খোঁজ পেতে গেলে পৌঁছাতে হবে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। ভারত-ভুটান সীমান্তের কাছে শুভপাড়া, ধুনচিপাড়া, পঞ্চায়েত পাড়া অঞ্চলে বসবাস টোটো জনগোষ্ঠীর। তাঁদেরই মাতৃভাষা ‘টোটো’। টোটো মূলত সিনো-তিবেতিয়ান ভাষা। ২০১৪ সালের সমীক্ষায় ‘অত্যন্ত সঙ্কটজনক’ বিভাগে এই ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেস্কো। বাংলা এবং নেপালি ভাষার বাড়তে থাকা প্রভাব দিন দিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই ভাষাকে। ২০১৪ সালের গণনা অনুযায়ী এই ভাষার বক্তা ১৪১১ জন। এখন হয়তো আরও কমে দাঁড়িয়েছে এই সংখ্যাটা!

/১০

ধিমাল বা ধেমাল ভাষা— ১৯৬৭-র নকশাল আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল এই গ্রাম থেকেই। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি ব্লক। এই ব্লকেই ছোট্ট গ্রাম কেতুগাবজোত। সেখানেই বসবাস ধিমাল জনগোষ্ঠীর। সব মিলিয়ে তাঁদের এই মাতৃভাষায় কথা বলেন হাজার জন। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মূলত নেপালে এবং ভুটানের কিয়দাংশে লক্ষ্য করা যায় এই ভাষা। বিশ্বব্যাপী ২০ হাজার মানুষ ব্যবহার করেন ধিমাল ভাষা। তবে পশ্চিমবঙ্গে ‘বিপন্ন’-এর তকমা জুড়ে গেছে এই ভাষায়।

/১০

কয়া— কয়া ভাষা দ্রাবিড়িয়ান ভাষা পরিবারের অংশ। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড এবং দক্ষিণ ভারতে ব্যবহৃত হয় এই ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গোন্ডি উপজাতির মধ্যে চল রয়েছে কয়া ভাষার। তবে বাংলা এবং অন্যান্য উপভাষাগুলির প্রভাবে অবলুপ্তপ্রায় কয়া ভাষা।

/১০

শবর ভাষা— শবর জনগোষ্ঠীর বসবাস ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে। মুন্ডা জনগোষ্ঠীর একটি শাখা এই সম্প্রদায়। পশ্চিমবঙ্গে মূলত পুরুলিয়ায় বসবাস এই সম্প্রদায়ের। তাছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে মেদিনীপুরেও রয়েছেন শবররা। জঙ্গল এবং চাষাবাদের ওপরে নির্ভর করেই তাঁদের দিনযাপন। এই ভাষায় বক্তার সংখ্যা বর্তমানে ১ লক্ষেরও কম। বাংলা এবং সাঁওতালি— দুই ভাষারই সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে শবর ভাষায়।

/১০

হাজং— ইন্দো-আর্য এবং তিবেতো-বর্মান— এই দুই ভাষা পরিবারের মিশ্রণে জন্ম হাজং ভাষার। আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল— বলতে গেলে পূর্ব ভারতের প্রায় সব রাজ্যেও কম-বেশি দেখতে পাওয়া যায় হাজং ভাষার ব্যবহার। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ির কিছু অংশে চল রয়েছে এই ভাষার। তাছাড়া বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও সিলেটে ব্যবহৃত হয় হাজং ভাষা। সব মিলিয়ে বক্তার সংখ্যা ৭২ হাজার। আর আমাদের রাজ্যে তা হাজারেরও কম। অন্য ভাষাদের ভিড়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রাচীন ভাষা।

/১০

থারু ভাষা— আওয়াধি, ভোজপুরি এবং মৈথিলী ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি থারু ভাষা। তবে এই ভাষার রয়েছে আলাদা ব্যকরণ। বুকসা এবং থারু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ব্যবহার করেন এই ভাষা। সব মিলিয়ে ভারতে এই ভাষার বক্তার সংখ্যা চার লক্ষের কাছাকাছি। পশ্চিমবঙ্গে বীরভূমের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চল রয়েছে এই ভাষার। তবে বক্তার সংখ্যা হাতে গোনা। বাংলার বাইরে বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তরাখন্ডে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে থারু ভাষা।

/১০

মালতো ভাষা— কখনো পাহাড়িয়া, কখনো বা রাজমহলী কিংবা রাজবংশী নামেও পরিচিত এই ভাষা। এই ভাষা উত্তর দ্রাবিড়িয়ান ভাষা পরিবারের অংশ। যদিও এই ভাষার দুটি ভাগ রয়েছে। কুমারগড় পাহাড়িয়া ও সৌরিয়া পাহাড়িয়া। ২০০১ সালের সেনসান অনুযায়ী ভাষার বক্তার সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে মাল অঞ্চলে এবং কোচবিহারের কিছু অংশে ব্যবহৃত হয় এই ভাষা। তবে আলাদা করে কোনো হরফ নেই এই ভাষার। বাংলা ভাষার হরফেই লেখা হয় মালতো। আর বাংলার বাইরে ব্যবহৃত হয় দেবনাগরী হরফ।

১০/১০

রাউতিয়া ভাষা— রাউতিয়া মূলত রাউত সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা। পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর অঞ্চলে সামান্য কিছু মানুষের মধ্যে ব্যবহৃত হয় এই ভাষা। ইতিহাস জানায় রাজপুত রাজাকে সুরক্ষা প্রদান করার কাজ করত এই সম্প্রদায়। আর তার প্রতিদান হিসাবেই ছোটনাগপুর অঞ্চল রাউতদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। তবে এই ভাষার মধ্যে মিশেছে হিন্দির সাদরি উপভাষা। সেইসঙ্গে প্রশাসনিক কিংবা পঠনপাঠনের জন্য এই ভাষার ব্যবহার না থাকায় অবলুপ্তির পথে রাউতিয়া। বাংলা ছাড়াও ওড়িশা, ঝাড়খন্ড ও বিহারে এই ভাষার ব্যবহার রয়েছে।

Powered by Froala Editor