পৃথিবীর প্রথম মহিলা পিএইচডি প্রাপক এলিনা, ছাড়তে হয়েছিল পছন্দের বিষয়ও

সময়টা ৩৫০ বছর আগে। ক্যালেন্ডারের পাতায় বলছে দিনটা ২৫ জুন, ১৬৭৮ সাল। রিপাবলিক অফ ভেনিসের পাদোয়া ইউনিভার্সিটি চত্ত্বরে সেদিন উপচে পড়েছে ভিড়। শহরের গণ্যমান্য মানুষরা তো এসেছেনই। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ইউরোপের আরও নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। এমন দৃশ্য তাঁরা কেউ কখনও দেখেননি। দেখবেন, এমনটা কল্পনাও করেননি। সেদিন পাদোয়া ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে কৃতি পড়ুয়াদের ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়ার দিন। আর সেই তালিকায় রয়েছেন এলিনা লুক্রেজিয়া করনারো পিসকোপিয়া (Elena Lucrezia Cornaro Piscopia)। আপাতভাবে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। কিন্তু কারণ একটাই, এলিনা একজন মহিলা। হ্যাঁ, তিনিই ইউরোপের, তথা পৃথিবীর প্রথম মহিলা পিএইচডি প্রাপক (First Woman PhD Holder)।

সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি, ইউরোপে তখন সামন্ততন্ত্রের শেষ যুগ চলছে। একদিকে যেমন প্রবল সংস্কারপন্থী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনই ভাঙছে সামাজিক আগল। ঠিক এইরকম একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ১৬৪৬ সালে জন্ম হল এলিনার। ভেনিসের অভিজাত পরিবারের মেয়ে এলিনা। তবে তাঁর পরিবার প্রথম থেকেই চেয়েছিল, পুরুষদের মতোই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচুক মেয়েরাও। আর তার জন্য প্রথমেই চাই শিক্ষা। স্থানীয় গির্জার পাদ্রি জিওভান্নি ফাবরিসের উপদেশে মেয়ের জন্য নানা ভাষার শিক্ষক রাখলেন গিনাবাতিস্তা পিস্কোপিয়া, অর্থাৎ এলিনার বাবা। শুরুটা হয়েছিল প্রাচীন রোমান ও গ্রিক ভাষা দিয়ে। এরপর একে একে ল্যাটিন, আরবি, ফার্সির মতো ভাষা শিখলেন এলিনা। মাত্র ৭ বছর বয়সেই ৭টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। এই নিয়েও বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল শহরে।

কৈশোর জীবনের শেষদিকে এসে জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্বের মতো জটিল বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় এলিনার। শিক্ষকও পেয়েছিলেন মনের মতো। সেই সময় ভেনিসের প্রখ্যাত জ্যামিতিবিদ কার্লো রিনালদিন তাঁর শিক্ষার দায়িত্ব নিলেন। রিনালদিনি তো এলিনাকে নানা বিষয় শেখালেনই, এমনকি এলিনাও নানা বিষয়ে প্রভাবিত করেছিলেন তাঁকে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন রিনালদিনি তাঁর জ্যামিতি বিষয়ক গবেষণার বইটি উৎসর্গ করেন তাঁর এই ছাত্রীটিকে। ফলিত বিজ্ঞানের পাশাপাশি চলছিল থিওলজির চর্চাও। এমনকি কারথুসিয়ান সন্ন্যাসী ল্যান্সপারগিয়াসের লেখা একটি বই স্প্যানিস থেকে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন এলিনা।

১৬৬৯ সালে এলিনা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মহিলা হিসাবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করাও তখন এক বিরল কৃতিত্ব। কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে চাইলেন না এলিনা। মনে মনে ইচ্ছা, তিনি থিওলজিতেই ডক্টরেট করবেন। এলিনার ইচ্ছার কথা জানতে পেরে রিনালদিনি যোগাযোগ করলেন পাদুয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফেলিসি রটোন্ডির সঙ্গে। রটোন্ডি এই প্রস্তাব নিয়ে গেলেন বিভাগীয় অধ্যক্ষ গ্রেগরিও বারবারিগোর কাছে। রটোন্ডির মতো অধ্যাপকের প্রস্তাবে প্রথমে কোনোকিছু না শুনেই হ্যাঁ বলেছিলেন গ্রেগরিও। কিন্তু ছাত্রী নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হতেই তিনি চমকে উঠলেন। একজন মহিলা হয়ে ডক্টরেট করতে চান এলিনা! শেষ পর্যন্ত অবশ্য থিওলজি নিয়ে পড়াশোনা আর হল না। গ্রেগারিও বোঝালেন, থিওলজি যেহেতু ধর্ম বিষয়ক চর্চা, তাই এক্ষেত্রে নানারকম অবাঞ্ছিত আপত্তি আসতে পারে। বরং এলিনা দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করুক।

আরও পড়ুন
মহিলা শিল্পীদের কি প্রদর্শনীতে উলঙ্গ হয়ে ঢুকতে হবে? প্রশ্ন তুলেছিলেন গেরিলা গার্লরা

শেষ পর্যন্ত তাই স্থির হল। আর ৬ বছর ধরে পড়াশোনা করে অবশেষে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রিও পেলেন এলিনা। সেদিন বলোগনা, পেরুগিয়া, রোম, নেপলস থেকে কত না মানুষ এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে ছুটে এসেছিলেন ভেনিসে। ডিগ্রি অর্জনের পরেও পড়াশোনা থেমে থাকেনি এলিনার। কিন্তু সেই পথ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পিএইচডি অর্জনের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে তাঁর। সপ্তদশ শতকে এই রোগের কোনো চিকিৎসাই ছিল না। ১৬৮৬ সালের ২৬ জুলাই, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে শেষ হয়ে যায় এলিনা পিসকোপিয়ার জীবন। শিক্ষাক্ষেত্রকে হয়তো বিশেষ কিছুই ফিরিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি তিনি। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের জন্য দরজাটা তিনিই প্রথম খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
মাঠে ফেরা ‘দিবাস্বপ্ন’, প্রাণভয়ে লুকিয়ে আফগান মহিলা ক্রিকেটাররা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
খোঁজ নেই প্রথম মহিলা আফগান গ্রাফিটি শিল্পীর; প্রতিবাদের মাশুল?