করোনার ফলে ব্যাপক বৃদ্ধি প্লাস্টিকের ব্যবহারে, বড়ো বিপদের আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর আতঙ্কের মধ্যেই আদতে ভালো দিক দেখা গিয়েছিল একটি ক্ষেত্রেই। দূষণের ভারে নুয়ে পড়া প্রকৃতি অনেকটাই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আবার। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় লকডাউন জারি হওয়ায় গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন এক ধাক্কায় কমে গিয়েছিল প্রায় ৫ শতাংশ। পরিবেশের উপর তার প্রভাব দেখা গিয়েছিল ব্যাপকভাবে।

কিন্তু যতই ডালপালা মেলেছে করোনা অতিমারী, ততই পরিবেশের উপর তার বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাবের দিকটিও সামনে আসছে প্রবলভাবে। তারমধ্যে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের বিশেষভাবে যেটা ভাবাচ্ছে, তা হল প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া। প্লাস্টিকের মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজারের বোতল এবং খাবারের প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিপুল হারে বাড়িয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯ বর্জ্য। রাস্তাঘাট, সমুদ্রতট এবং সামুদ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষভাবে।

যেভাবে করোনার ফলে ডিসপোজেবল বা শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করা যায় এমন পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে এবং তা থেকে দূষণের প্রবনতাও মাথাচাড়া দিয়েছে যথেষ্টই, তা কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর করেছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থার পরিবেশ বিজ্ঞানীদের। জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের ডিরেক্টর পামেলা কোক-হ্যামিলটনের মতে, করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই প্লাস্টিক দূষণ আমাদের গ্রহের জন্য অন্যতম বড় একটা হুমকি ছিল। এখন মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে এবং এই রোগ প্রতিরোধে নির্দিষ্ট পণ্যগুলির প্রতিদিনের ব্যবহার হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় আরও খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। প্রাথমিক ভাবে অতিমারীর মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকার ফলে এই দিকটিতে সেভাবে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা সংস্থা হিসেবে সুনাম থাকা গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী, শেষ এক বছরে বিশ্ব জুড়ে শুধুমাত্র ডিসপোজেবল ফেস মাস্কেরই বিক্রি বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ কোটি থেকে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটিতে। তাছাড়াও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে লাগাতার অনলাইন শপিংয়ে জোর দেওয়ার ফলে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া পণ্য। উদাহরণ হিসেবে সমীক্ষকরা তুলে এনেছেন সিঙ্গাপুরের ছবি। গত পয়লা জুন সিঙ্গাপুরে আট সপ্তাহের লকডাউনের মাথায় শুধুমাত্র বাড়িতে অনলাইনে কেনা জিনিসপত্র এবং ডেলিভারি হওয়া খাবারদাবারের জন্য ব্যবহৃত প্রায় ১৫০০ টন প্লাস্টিকের বর্জ্য জমা হয়েছিল রাস্তাঘাটে বা সমুদ্রে।

আরও পড়ুন
বাঁশের তৈরি টিফিনকৌটো, প্লাস্টিক রুখতে অভিনব উদ্যোগ মণিপুরে

আশঙ্কা প্রকাশ করে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যদি এই ধারাই বজায় থাকে তাহলে করোনা ভাইরাসের ফলে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং তা যেভাবে স্থলভাগ এবং সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করবে, তার প্রভাব দাঁড়াবে মারাত্মক। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে শুধু এই বর্জ্য সাফ করার জন্য। তা না হলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মৎস্য, পর্যটন এবং সামুদ্রিক পরিবহনের উপর।

তাহলে কি একেবারেই প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা? বলাই বাহুল্য, দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের কথা বলে আসা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেছে সামান্যই। খেলনা গাড়ি থেকে শুরু করে গৃহস্থালিতে রোজকার ব্যবহৃত সরঞ্জাম পর্যন্ত প্লাস্টিকের অবাধ গতিবিধি। তাই হঠাৎ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দিলে বিশ্বজুড়েই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কোক-হ্যামিল্টন। তবে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নীতি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, তা সঠিক সময়ে অনুধাবন করা হয়নি বলেই মনে করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির আভ্যন্তরীণ আইনি জটিলতা, প্রযুক্তি, ভর্তুকি, লাইসেন্স এবং নিষেধাজ্ঞার মত লাল ফিতের জটকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন
জমছে প্লাস্টিকের বর্জ্য, আবারও দূষণের শিকার ইংল্যান্ডের ‘গর্ব’ টেমস নদী

অগত্যা রেহাই কোথায়? লকডাউন আলগা হচ্ছে বিশ্ব জুড়েই। তাহলে কি প্রকৃতি আবারও ফিরে যাবে সেই আঁধারেই? জাতিসঙ্ঘ প্লাস্টিকের উত্পাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রাষ্ট্রগুলিকে অনুরোধ করছে যত দ্রুত সম্ভব বিকল্প খুঁজে বের করতেও। বায়োডিগ্রেডেবল বা সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদার্থগুলির তালিকায় প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে এমন অনেক পরিচিত পদার্থ যেমন কাচ, সিরামিক, প্রাকৃতিক তন্তু, কাগজ, পিচবোর্ড, প্রাকৃতিক রাবার ইত্যাদি ব্যবহারের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়েছে জীবিকা তৈরি করার প্রক্রিয়াটিও। যেহেতু উন্নয়নশীল দেশগুলির অনেকেই প্লাস্টিকের বিকল্পের মূল সরবরাহকারী, তাই সেগুলির বিশ্বব্যাপী চাহিদা তাদের জন্য নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিশ্বে পাটের প্রধান সরবরাহকারী হল বাংলাদেশ এবং ভারত। থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়া বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক রাবার রফতানিতে এগিয়ে। তাই বিকল্প জীবিকার সুযোগও বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে জানানো হয়েছে রিপোর্টে।

আরও পড়ুন
খাবারের সঙ্গে পাখির ভিতরে যাচ্ছে প্লাস্টিকও, চিন্তিত পরিবেশবিদরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More