‘Q’, ‘W’ এবং ‘X’— এই ৩টি বর্ণকে নিষিদ্ধ করেছিল তুরস্কের প্রশাসন!

ইংরাজিতে ‘ট্যাক্সি’ কথাটির বানান ‘Taxi’। এমনটাই তো ছোটো থেকে জেনে এসেছি আমরা। কিন্তু হঠাৎ করে যদি সরকার আদেশ দেয় আগামীদিন থেকে ‘ট্যাক্সি’ শব্দটির মধ্যে ব্যবহার করা যাবে না ‘X’ বর্ণটিকে, বদলে লিখতে হবে ‘KS’? 

বিষয়টা শুনতে যতটা হাস্যকর, ততটা আশ্চর্যজনকও বটে। রাতারাতি প্রচলিত কোনো বর্ণকে বদলে ফেলতে পারে নাকি কোনো সরকার? হ্যাঁ, আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এমনই আশ্চর্য এক ডেস্টোপিয়ান সময় হাজির হয়েছিল তুরস্কের (Turkey) বুকে। প্রায় সবদেশেই রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধার্মিক কারণে নিষিদ্ধ (Banned) হয় নানান গ্রন্থ, কখনো নিষিদ্ধ হয় বিশেষ কিছু শব্দমালা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে ১৯২০-র দশকে নিষিদ্ধ হয়েছিল ইংরাজি বর্ণমালার তিন-তিনটি অক্ষরের ব্যবহার। 

১৯২৮ সাল। তুর্কি ভাষার বর্ণমালা স্থায়ীভাবে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় তুরস্কের সরকার। তখনও পর্যন্ত তুর্কি লেখার জন্য ব্যবহৃত হত আরবি লিপি। আর সেটা হয়ে ওঠে মূল সমস্যার কারণ। প্রথমত, আরবি লিপি খুব সহজে আত্মস্থ করতে পারতেন না বিদেশি, বিশেষত পাশ্চাত্যের মানুষরা। অথচ, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তুরস্ককে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করে তুলতে ইউরোপীয় পর্যটকদের প্রয়োজন অনুভব করেন তুরস্ক প্রশাসন। অন্যদিকে সমীক্ষায় এও উঠে আসে, বর্ণমালা বা আরবি লিপি আয়ত্ত করা কঠিন হওয়ার কারণে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভাষা শিখতে বেশি সময় নেয় তুরস্কের ছাত্রছাত্রীরা। 

এই সমস্যার সমাধান হিসাবেই ১৯২৮ সালে বর্ণমালা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তুর্কির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুস্তফা কেমাল আতাতুর্ক। জানান, আরবির পরিবর্তে তুর্কি ভাষার লিপি হিসাবে দেশজুড়ে ব্যবহৃত হবে ল্যাটিন লিপি। তাতে যেমন একদিকে কথ্য তুর্কি ভাষা জানলে, সহজেই সাইনবোর্ড বা অন্যান্য লেখা পড়তে পারবেন বিদেশিরা, তেমনই সহজাতভাবে ইংরাজিও শিখতে পারবে দেশের কিশোর-কিশোরীরা। 

রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্ত তুরস্কের কাছে ঐতিহাসিক হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত। বদলে গিয়েছিল গোটা দেশের ছাপার পদ্ধতি। একসময় যেখানে তুর্কি ছাপার জন্য ব্যবহৃত হত ৫০০টির বেশি হরফ, সেই সংখ্যাটা নেমে আসে মাত্র ৫০-এর মধ্যে। সেইসঙ্গে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে বৃদ্ধি পায় শিক্ষার হারও। অবশ্য ‘A’ থেকে শুরু করে ‘Z’— এই ২৬টি ল্যাটিন বর্ণই স্থান পেয়েছিল তুর্কির নতুন বর্ণমালায়, এমনটা নয়। বরং, সেখানে ছিল ২৯টি অক্ষর। এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক, সেই আশ্চর্য বর্ণমালার ছবি—

A B C Ç D E F G Ğ H I İ J K L M N O Ö P R S Ş T U Ü V Y Z

একটু খেয়াল করলেই লক্ষ করা যাবে, এই বর্ণমালায় অনুপস্থিত ‘Q’, ‘W’ এবং ‘X’— এই ৩টি হরফ। পরিবর্তে ‘C’, ‘G’, ‘I’, ‘O’, ‘S’, ‘U’— এই ৬টি বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে দু’বার করে। আসলে মূল বর্ণের থেকে উচ্চারণের ভিন্নতা বোঝানোর জন্য কিছু বিশেষ চিহ্নের ব্যবহার করা হয়েছে এই বর্ণগুলির সঙ্গে। কিন্তু বাকি ৩টি বর্ণকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছিল এই বর্ণমালা থেকে? 

তুরস্ক প্রশাসনের যুক্তি ছিল, ‘Q’, ‘W’ এবং ‘X’— এই ৩টি বর্ণের উচ্চারণ করা সম্ভব ভিন্ন ভিন্ন হরফ দিয়ে। যেমন, ‘X’-এর উচ্চারণ হয় ‘ক্+স’। ফলে, সেক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে ‘KS’। তেমনই ‘Q’ এবং ‘W’-এর জায়গায় ব্যবহৃত হবে ‘K’ ও ‘V’। রাষ্ট্রপতি আতাতুর্কের এই সিদ্ধান্ত মেনেই ফার্সি নববর্ষ ‘নওরুজ’ (Nowruz) হয়ে ওঠে ‘নভরুজ’ (Novruz)। ‘Taxi’ হয়ে ওঠে ‘Taksi’। আর ‘জেরক্স’ (Xerox)? এই শব্দটির ব্যবহারই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় তুর্কি ভাষায়। বদলে ব্যবহৃত হতে থাকে ‘ফটোকপি’ শব্দটি। 

তবে শুধু ব্যবহার বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি রাষ্ট্রপতি আতাতুর্ক। বরং, এই তিনটি বর্ণকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি ভুল করে এই বর্ণগুলি ব্যবহার করে ফেললে দিতে হত জরিমানা। তুরস্কের কয়েক হাজার সরকারি কর্মচারীকে সে-যুগে ১০০ লিরার ফাইন ভরতে হয়েছে কেবলমাত্র এই তিনটি হরফের ব্যবহারে। কিন্তু ল্যাটিন বর্ণমালা থেকে এ কি শুধুই প্রেসিডেন্টের খামখেয়ালিপনা? 

না, তেমনটা নয়। আসলে, এই তিনটি বর্ণের বা উচ্চারণের ব্যবহার তুর্কি ভাষায় নেই বললেই চলে। বরং, এই বর্ণগুলি মূলত ব্যবহার করত কুর্দিরা। তুরস্কের আজ তো বটেই, সে-যুগেও সংখ্যালঘু ছিল কুর্দিরা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তাদের জনসংখ্যা ছিল সে-সময় তুরস্কের মাত্র ২০ শতাংশ। কুর্দিরা যাতে বাধ্য হয়ে তুর্কি ভাষার ব্যবহার করে, তার জন্যই এই বিশেষ সিদ্ধান্ত নেন আতাতুর্ক— এমনটাই অভিমত অনেকের। তা নিয়ে সে-সময় প্রতিবাদেও নেমেছিলেন বহু বুদ্ধিজীবী। আবার ঐতিহ্যবাহী লিপি পরিবর্তনের বিরোধিতাতেও সরব হয়েছিলেন অনেকে। তবে তাতে লাভ হয়নি কিছুই।   

মজার বিষয় হল, ১৯২৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এই নতুন বর্ণমালা প্রবর্তনের বছর তিনেকের মধ্যেই দেশের অধিকাংশ জনগণের কাছে এই বর্ণমালাকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল তুরস্ক। বিশেষত, চল্লিশোর্ধ্ব মানুষদের এই নতুন লিপির শিক্ষা দেওয়া রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল প্রশাসনের কাছে। পাশাপাশি গোটা দেশের প্রিন্টিং ব্যবস্থাকেও বদলে ফেলতে হয়েছিল রাতারাতি। বদলে গিয়েছিল শহরের সমস্ত হোর্ডিং, রাস্তার নাম, সাইনবোর্ড। 

তবে এই নতুন বর্ণমালা দেশের সব মানুষ ব্যবহার করলেও, ‘Q’, ‘W এবং ‘X’-এর প্রচলন শুরু করার জন্য প্রতিবাদ থেমে থাকেনি কখনোই। যার ফলস্বরূপ ২০১৩ সালে বাধ্য হয়ে এই তিনটি বর্ণকে নিষিদ্ধের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয় তুরস্ক প্রশাসন। তবে আজ কুর্দিরা এই তিনটি হরফ ব্যবহার করলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও সেগুলি অনুপস্থিত তুরস্কের বর্ণমালায়…

Powered by Froala Editor

More From Author See More