এজলাসে হাজির গুবরে পোকা, কী রায় দিলেন বিচারপতি?

মশা কিংবা অন্যান্য কীট-পতঙ্গের উৎপাত নেই— ভূ-ভারতে এমন জায়গা খুঁজে পাওয়াই বিরল। পতঙ্গদের এই উৎপাত ঠেকানোর জন্য, সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাজারে এসে চলেছে নিত্যনতুন সামগ্রী। কখনও রাসায়নিক কীটনাশক, কখনও আবার প্রতিরোধক ক্রিম, পতঙ্গ নিরোধক ধূপ, বৈদ্যুতিক যন্ত্র— সবকিছুকেই হাতিয়ার করে নিয়েছে মানুষ। কিন্তু পতঙ্গদের বিরুদ্ধে উৎপাতের অভিযোগ তুলে যদি কেউ দ্বারস্থ হন বিচারালয়ের?

মধ্যযুগের ইউরোপ (Medieval Europe) সাক্ষী হয়েছিল এমনই এক আশ্চর্য ঘটনার। ফরাসি শহর সেন্ট জুলিয়ানের মানুষজন আদালতের কাঠগড়ায় তুলেছিল ‘রাইনকাইটিস অরাটাস’ প্রজাতির গুবরে পোকাদের। কিন্তু কী কারণে আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাদের? শেষ পর্যন্ত কী রায় শুনিয়েছিলেন আদালতের বিচারপতি? 

অকুস্থল ফ্রান্সের পশ্চিম উপকুলে অবস্থিত সেন্ট জুলিয়েন শহর। প্রাচীনকাল থেকেই ওয়াই-এর জগতে বেশ নামডাক এই ছোট্ট শহরের। এমনকি আজও সেই খ্যাতি ধরে রেখেছে সেন্ট জুলিয়েন। ক্ষেতের পর ক্ষেতজুড়ে সেখানে চাষ হয় আখ এবং আঙুর। আর সেই কৃষিক্ষেত্র সংলগ্ন কারখানায় সেই ফসলের প্রক্রিয়াকরণ করে বানানো হয় চিনি এবং দ্রাক্ষারস তথা ওয়াই। 

সেটা ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। গোটা সেন্ট জুলিয়েন-জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গুবরে পোকাদের (Weevils) উপদ্রব। ফসল নষ্ট করা থেকে শুরু করে, সদ্য রোপণ করা আঙুর গাছ কেটে ফেলা— পোকাদের দস্যিপনায় অস্থির হয়ে ওঠে স্থানীয় কৃষকরা। এমনকি রীতিমতো ডুবতে বসে রাজ্যের অর্থনীতি। এটা যে-সময়ের কথা হচ্ছে, তখনও পর্যন্ত আজকের মতো রাসায়নিক কীটনাশকের বাড়বাড়ন্ত ছড়িয়ে পড়েনি বাজারে। বৈদ্যুতিক ফেন্সিং-এর কথাও মানুষের কল্পনার বাইরে। ফসল রক্ষা করার একমাত্র উপায়, জাল কিংবা বেড়া দিয়ে শস্যক্ষেত ঘিরে ফেলা। তাতে গরু-ছাগলকে আটকানো গেলেও, খুদে পোকাদের আটকানো সম্ভব নয় মোটেই। ফলে, বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হয় সাধারণ মানুষ। 

ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী সেটা ১৫৪৫ সাল। দ্রাক্ষাক্ষেত থেকে বেশ কিছু গুবরে পোকাকে ধরে বোতলবন্দি করে হাজির করা হয়েছিল ধর্মীয় আদালতে। আর সেই ‘ঐতিহাসিক’ এজলাসের বিচারক ছিলেন সেন্ট জিন-ডি-মৌরিনে। সুবিচার হওয়া তো দূরের কথা, স্থানীয়দের এই আশ্চর্য কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ধর্মযাজক। আসলে অভিযোগকারীরা উকিল নিয়ে হাজির হলেও, কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে মামলা— সেই খুদে অভিযুক্তদের প্রতিনিধি কে? তারা যে নিজেরাও কথা বলতে পারে না। তৎকালীন ফ্রান্সের ধর্মীয় আদালতের নিয়ম ছিল, আর্থিকভাবে সক্ষমতা না থাকলে কোনো দোষী বা অভিযুক্তের হয়ে আইনি প্রতিনিধির ব্যবস্থা করতেন স্বয়ং বিচারপতি। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি তার। গুবরে পোকাদের জন্যও প্রতিরক্ষা অ্যাটর্নি নিয়োগ করেছিল সেন্ট জুলিয়েনের আদালত। 

মজার বিষয় হল, শেষ পর্যন্ত বাজি জিতে যান পোকাদের সেই অ্যাটর্নিই। তাঁর যুক্তি ছিল, এই দোষ আসলে মানুষেরই। প্রয়োজনের থেকেও মাত্রাতিরিক্ত ওয়াইন উৎপাদন এবং মদ্যসেবনের কারণেই ঈশ্বর ক্ষুব্ধ হয়েছেন মানুষের ওপর। আর তিনি এই গুবরে পোকাদের মাধ্যমেই তাঁর ঐশ্বরিক বিচার পৌঁছে দিচ্ছেন মানুষের কাছে। মামলার রায়ে অভিযোগকারীদের ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা এবং অনুতপ্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বিচারপতিও। পাশাপাশি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, প্রতিরক্ষা-অ্যাটর্নির বেতনের এক-দশমাংশ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে অভিযোগকারীদের। এরপর স্থানীয় কৃষকরা বেশ কয়েকটি গণসমাবেশ আয়োজন করলেও, লাভ হয়নি কোনো। তবে আশ্চর্যজনকভাবে মাস কয়েকের মধ্যেই রণে ভঙ্গ দেয় গুবরে পোকারা। সে-যুগে অনেকেই মনে করেছিলেন, মানুষের পাপস্খলনে এবং ক্ষমা-প্রার্থনায় হয়তো তুষ্ট হয়েছেন ঈশ্বর। 

অবশ্য বছর দুয়েকের মধ্যেই ফের দেখা দেয় এই একই সমস্যা। আবারও কাঠগড়া, আবারও রায় গিয়েছিল পোকাদের পক্ষেই। অবশ্য সেবার ভিন্ন যুক্তি দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা-অ্যাটর্নি। তুলে এনেছিলেন ‘জেনেসিস’ গ্রন্থের উক্তি। পৃথিবীর সব প্রাণীরাই যে ঈশ্বরের সৃষ্ট। মানুষের মতো তাঁরাও একই প্রভু— ঈশ্বরের সন্তান। ফলে শেষ অবধি পোকাদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয় আদালত থেকে। 

তবে এবার আর হাল ছাড়েননি স্থানীয়রা। টানা ৮ মাস ধরে ধর্মীয় আদালতের সঙ্গে টানাপোড়েন চলেছিল স্থানীয় কৃষকদের। একাধিকবার শুনানি হয়েছিল এই বিচারের। কী ছিল সেই বিচারের অন্তিম ফলাফল? না, তা জানার কোনো উপায়ই অবশিষ্ট নেই আজ। কারণ, প্রায় একশো পাতার সেই দলিল থেকে হারিয়ে গেছে শুধু শেষ কয়েকটি পাতা। সেখানেই লিখিত ছিল চূড়ান্ত ফলাফল। 

তবে যাই হোক না কেন, মধ্যযুগের এই আশ্চর্য কাহিনি আজও রীতিমতো অবাক করে মানুষকে। শুধু গুবরে পোকাই নয়, একইভাবে সে-সময় বিচার চলত শূকর, ছুঁচো, বানর, উইপোকা-সহ ভিন্নভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং প্রাণীর। কখনও কখনও তাদের বিরুদ্ধে জারি করা হত মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বজুড়েই অন্যতম আলোচিত বিষয় হল প্রাণী অধিকার। তবে মজার বিষয় হল, এই আইনের সূত্রে বন্যপ্রাণী হত্যা ও তাদের উপর অত্যাচার অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হলেও, এই তালিকায় আজও জায়গা করে নিতে পারেনি পতঙ্গরা। পতঙ্গনিধন নিয়ে অধিকারকর্মীদেরও মাথাব্যথা নেই কোনো। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে মধ্যযুগীয় এক আদালত রায় শুনিয়েছিল তাদের পক্ষেই। এমনটা কল্পনা করলেও অবাক হতে হয় বৈকি!

Powered by Froala Editor