ভেন্ট্রিকুইলিজমের পুতুলে সেজে উঠেছে পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর, কোথায়?

ভেন্ট্রিকুইলিজমের (Ventriloquism) পুতুল বা কথা বলা পুতুলের সঙ্গে পরিচিত প্রায় সকলেই। শিল্পী নিজে কথা বললেও মনে হয় যেন পুতুলের মুখ থেকে ভেসে আসছে সেই স্বর। সেই আশ্চর্য জাদুতে মুগ্ধ হয় আট থেকে আশি প্রত্যেকেই। আর বহু যত্নে রাখা হয় পুতুলটিকেও, তাঁর নিজের বিদ্যা ছাড়া সেটিই তো শিল্পীর সবথেকে প্রিয় বন্ধু। আদরের নামে ডাকা হয় তাদের। কিন্তু তারপর? বয়স বাড়তে থাকলে নিশ্চয়ই বাতিল হয়ে যায় তারা। স্থান হয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে। কিন্তু আমেরিকায় আছে এমন এক জাদুঘর, যা সেজে উঠেছে শুধুমাত্র ভেন্ট্রিকুইলিজমের পুতুল দিয়েই। যার নাম ভেন্ট হাভেন (Vent Haven) মিউজিয়াম। পৃথিবীতে এরকম সংগ্রহশালা আর দ্বিতীয়টি নেই বলেই দাবি কর্তৃপক্ষের।

ওহায়ো প্রদেশের বিখ্যাত শহর সিনসিনাটি। তার ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে ফোর্ট মিচেল, কেনটাকিতে অবস্থিত এই জাদুঘর। ১৯৭৩ সালে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও এর গল্প জানতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় একশো বছর অতীতে। ভদ্রলোকের নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বার্গার (W.S. Berger)। এই নামের কোনো বিশেষ তাৎপর্য ছিল কিনা জানা নেই, তবে ছোটো থেকেই তাঁর আকর্ষণ ছিল ভেন্ট্রিকুইলিজমের প্রতি। অভিনেতা পিতার সূত্রে দীর্ঘদিন কেটেছে মঞ্চের পিছনে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্বরনিক্ষেপের পদ্ধতি আর মুখোশের ব্যবহার দেখে নিজের ইচ্ছে হয় অভিনব কিছু করার। কিছুদিন চেষ্টা করেন ভেন্ট্রিকুইলিজম বিদ্যা আয়ত্ত করার। যদিও জীবন বয়ে যায় অন্যখাতে।

ক্রমে সাফল্য পেয়েছেন নিজের ব্যবসায়। ভুলেই যেতে বসেছিলেন ছোটোবেলার ভালোবাসাকে। ১৯১০ সালে নিউ ইয়র্কে গিয়ে আচমকাই চোখে পড়ে কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য কথা বলা পুতুল। যার নির্মাতা ছিলেন টমি ব্যালোনি। সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে ভিড় করল পুরনো স্মৃতিরা। সেগুলি কিনে নিয়ে ঠিক করলেন, তৈরি করবেন নিজস্ব একটি সংগ্রহশালা। এরপর তিনি বিশ্বের যে প্রান্তেই গেছেন, সেখান থেকেই কিনে এনেছেন ভেন্ট্রিকুইলিজমের পুতুল। শুধু তাই নয়, সেই সংক্রান্ত বিদ্যার ১৫০০ বই, ৫০০০ ছবি ও কয়েকশো দুর্মূল্য মুখোশ সংগ্রহ করেন তিনি। আর মোট পুতুলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০। জিমি নেলসন, উইলি টাইলার বা জে জনসনের মতো বিখ্যাত ভেন্ট্রিকুইলিজম শিল্পীর আসল পুতুলগুলি কিনে নেন তিনি। এডগার বার্গেন, পল উইনচেল, সারি লুইস প্রমুখের পুতুল কিনতে না পারলেও, সেগুলির ‘রেপ্লিকা’ ছিল তাঁর অধীনে।

১৯৭২ সালে মৃত্যু ঘটে বার্গারের। পরের বছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরো পুতুল সংগ্রহ করে শুরু হয় ভান্ট হাভেনের পথ চলা। এখন মোট ১১০০ পুতুল রয়েছে এখানে। তবে শুধুমাত্র মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খোলা থাকে এটি। কিছু পুতুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশ্চর্য সব গল্প। যেমন উইলিয়াম উডের চারটি পুতুল। ১৯০৮ সালে মেক্সিকোর উপসাগরে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু ঘটে তাঁর। জলের স্রোতে ভেসে যায় পুতুলগুলি। পরে সেগুলি উদ্ধার করা গেলেও কীভাবে বার্গারের হাতে এসে পৌঁছোল, তা কখনই ব্যাখ্যা করেননি তিনি। 

আরও পড়ুন
কথার জাদুতে মোড়া দৈববাণী, ভুল অর্থে ‘ফাঁদে’ পড়েছেন বহু সম্রাট

কিংবা ধরা যাক এরিক এভার্টির অসম্পূর্ণ পুতুলটি। চোখদুটি কোটরে বসানো, কপাল থেকে ঠোঁট পর্যন্ত নেমে এসেছে কাটা দাগ। রংহীন, অদ্ভুতদর্শন পুতুলটি দেখে বুক কেঁপে উঠতে পারে বহু মানুষের। কেন এই অবস্থা পুতুলটির? এরিক যখন এই পুতুলটি বানান, তখন তিনি সোভিয়েত সরকারের হাতে বন্দি। সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সম্বল বলতে আছে কিছু কাছের টুকরো আর একটি ছুরি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তিনি যেন প্রয়োজন বোধ করলেন এক বন্ধুর। আর তাই কাঠ কেটে তৈরি করেন পুতুলটি। 

আরও পড়ুন
আজও যুদ্ধবিধ্বস্ত দিনগুলির সাক্ষ্য বহন করে হুন্দেরমানের ‘স্মৃতির জাদুঘর’

আবার শিল্পী জিম টেটেরের শখ ছিল আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের পুতুল বানানো। তিনি কলেজে পড়াকালীন এক বন্ধু জন এফ. কেনেডির মূর্তি বানান। পরে সেই ছাঁচটি ফেলে দিতে চাইলে সাগ্রহে গ্রহণ করেন টেটর। তারপর থেকে জর্জ বুশ, বিল ক্লিন্টন, লাইডন বি. জনসনের পুতুল বানিয়েছেন তিনি। আর সবকটিই সংরক্ষিত আছে ভেন্ট হাভেনে। তবে বার্গারের সবচেয়ে প্রিয় পুতুল ছিল ‘স্কিনি হ্যামিলটন’। নিরীহ, ভালোমানুষের মতো দেখতে এই পুতুলটি জীবনের কঠিন দিনগুলিতে সঙ্গ দিয়েছিল তাঁকে। বার্গার তখন কলেজের ছাত্র। বন্ধুহীন জীবনে ভর করেছে একাকিত্ব। তখনই ‘স্কিনি’-র সঙ্গে বন্ধুত্ব তাঁর। পুতুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঝালিয়ে নিলেন পুরনো অভ্যাস। তারপর দুই ‘বন্ধু’ মিলে বেশ কিছু অনুষ্ঠান করেছিলেন আমেরিকাতে।

ছোটো শিশুরা যেভাবে আঁকড়ে ধরে পুতুলকে, ঠিক সেভাবেই বার্গার ভালোবেসেছিলেন পুতুলদের। কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। নিজের জীবনের আফসোস, কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছিল সংগ্রহশালার মাধ্যমে। হয়তো তারা প্রাণহীন জড়পদার্থ, তবু আসল জাদুতে তারাই কথা বলে ওঠে মানুষের সঙ্গে। জীবনে শুধু প্রয়োজন সেই জাদুর, সেই বন্ধুর। নাহলে তো সব মানুষই আসলে নিজের নিজের জাদুঘরে বন্দি। 

Powered by Froala Editor