বিদেশ সফরে গিয়ে আচমকা উধাও শ্রীলঙ্কা দল, রহস্যটা কী?

২০০৪ সাল। শ্রীলঙ্কার (Sri Lanka) হ্যান্ডবল (Handball) দল প্রীতিম্যাচ খেলতে এসেছে জার্মানিতে (Germany)। এমনিতে শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, গোটা উপমহাদেশেই খুব একটা জনপ্রিয় নয় হ্যান্ডবল খেলা। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে তো অনেকে পরিচিতই ছিল না এই খেলার পদ্ধতির সঙ্গে। তারপরেও শক্তিশালী জার্মানির বিরুদ্ধে খেলতে সে দেশে পৌঁছে গেল তারা। ক্রমে এগিয়ে আসছে ম্যাচের দিন। জার্মানি দল নিজেদের যত অনুশীলনের মধ্যে ডুবিয়ে দিচ্ছে, ততই যেন খোলা মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা। অনেকেরই সন্দেহ হয়েছিল এই নিয়ে। কিন্তু তার পরিণতি যে এরকম হতে পারে, সেটা বোধহয় ভাবতে পারেনি কেউই। ম্যাচের পরদিন ভোরে আচমকাই গায়েব হয়ে গেল গোটা দলটি। বহু খোঁজাখুঁজি করেও তখন কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তাদের।

গল্পটা শুরু করা যাক আরেকটু আগে থেকে। ২০০৩ সালে এশিয়ান-জার্মান স্পোর্টস এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম (AGSEP) নামের একটি সংগঠনের তরফ থেকে দুই মহাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়ানোর জন্য আয়োজন করা হয় কয়েকটি প্রতিযোগিতা। হ্যান্ডবলও ছিল তার মধ্যে। সংগঠনের তরফ থেকে শ্রীলঙ্কার ক্রীড়াদপ্তরে প্রস্তাব রাখা হয় জার্মানির সঙ্গে তাদের হ্যান্ডবল ম্যাচ আয়োজনের। এদিকে সে দেশে তখন হ্যান্ডবলের কোনো দলই নেই। হয়তো হাতে গোনা কয়েকজনের ধারণা আছে খেলাটির বিষয়ে। কিন্তু যতই হোক, এত বড়ো একটি প্রস্তাবকে খারিজ করেনি শ্রীলঙ্কার ক্রীড়াদপ্তর। ফলে দ্রুত কোচ হিসেবে নিযুক্ত করা হয় আথুলা ওইজেনায়াকা নামের একজন হ্যান্ডবল খেলোয়াড়কে। তাঁর উপরেই দায়িত্ব ছাড়া হয় দল তৈরির।

হাতে মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ সময়। কোনোরকমে একটি দল তৈরি করলেন আথুলা। পেশাদার খেলোয়াড় সেখানে কেউ নেই। বড়োজোর বয়সভিত্তিক স্তরে বাস্কেটবল কিংবা ফুটবলের গোলকিপিং করার অভিজ্ঞতা নিয়ে ২৩ জন খেলোয়াড় মুখোমুখি হল বিশ্বের অন্যতম সেরা দলের। ফলাফল যা হওয়ার ছিল, তাই হল। ৩০ মিনিটের দুটি অর্ধে জার্মানি দলের কাছে ৩৬ গোল হজম করে তারা। তখনই অবশ্য ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল জার্মানরা। কোনো পরিকাঠামো নেই, খেলার আয়োজন করা হয়েছে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক মাঠে। এমনকি শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা বল পর্যন্ত ধরতে পারে না ভালো করে। কোনো উচ্চবাচ্য না করেই ফিরে যায় তারা। এবার অপেক্ষা শ্রীলঙ্কা দলের বিদেশ সফরের। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ভিতরে ভিতরে কী পরিকল্পনা চলছে তাদের মধ্যে?

২০০৪ সালের মে মাসে গোটা দল পৌঁছোয় জার্মানিতে। জার্মানিতে এসে তারা নিয়মিত বেরিয়ে পড়ত বিখ্যাত স্থানগুলি দেখতে। সারাদিন এভাবেই কেটে যেত, মাঠের ধারেকাছে ঘেঁষত না কেউ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল এই নিয়ে, কিন্তু তারা পাত্তাও দেয়নি এসবে। ১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত হ্যান্ডবল ম্যাচেও বিশ্রীভাবে পরাজিত হয় শ্রীলঙ্কা দল। সেদিন রাতে জার্মান দল নৈশভোজে নিমন্ত্রণ জানায় তাদের। খাওয়াদাওয়ার পর যেন কিছুতেই তর সইছিল না আর। কাল সকালেও আবার তারা ঘুরতে বেরোবে, এই যুক্তি দিয়ে চলে আসে হোটেলে। ১৮ তারিখ ভোরবেলা বেরিয়ে পড়ল গোটা দল। কেউ সন্দেহ করেনি তাদের আচরণে। কিন্তু বেলা বাড়তেও কেউ ফিরে না আসায়, খবর দিতে হল পুলিশকে। হোটেলের ঘর থেকে পাওয়া যায় ডায়েরির একটি ছেঁড়া পাতা। সেখানে স্পষ্ট লেখা যে, তাদের পরবর্তী গন্তব্য ফ্রান্স। জার্মানদের অভ্যর্থনাকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে না বলে চলে যাওয়ার জন্য।

আরও পড়ুন
হারিয়ে-যাওয়া পরিবারের সঙ্গে পালিত সন্তানদের পুনর্মিলন, নেপথ্যে শ্রীলঙ্কার ট্যাক্সিচালক

আসলে কিন্তু ফ্রান্স নয়, তাদের গন্তব্য ছিল ইতালি। ঘুরতে নয়, চাকরি খুঁজতে। পরিকল্পনা ছিল, সেখানেই সারাজীবনের জন্য থেকে যাওয়ার। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন অত্যন্ত সংকটজনক। রাজনৈতিক অবস্থার জন্য অনেকে পালিয়েছে দেশ ছেড়ে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছোটোখাটো কাজ করছে ইতালিতে। শ্রীলঙ্কার হ্যান্ডবল দলের খেলোয়াড় চন্দনা বা রূপাসিঙ্গে-র আত্মীয়রাও সেখানেই থাকে। একবার সেখানে পৌঁছোতে পারলে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, এরকমই বিশ্বাস ছিল চন্দনাদের। ছোটোবেলায় বাস্কেটবল খেলেছেন, তাই হ্যান্ডবলের খবরটি জানতে পেরেই নাম লেখান সেই দলে। ক্রমে সকলেই সামিল হয় এই পরিকল্পনায়।

আরও পড়ুন
খেলেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালও, পেটের দায়ে বাস চালাচ্ছেন শ্রীলঙ্কার তারকা স্পিনার

যদিও এই ঘটনার ফলে সম্পর্ক খারাপ হয় দুই দেশের মধ্যে। শাস্তির মুখে পড়তে হয় এশিয়ান-জার্মান স্পোর্টস এক্সচেঞ্জকেও। এমনকি জার্মানির তরফ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ভবিষ্যতে আর কোনো শ্রীলঙ্কার ক্রীড়াদলকে সে দেশে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। যদিও সে সব ছিল কথার কথা। কারণ পরে তারা বুঝতে পারে শ্রীলঙ্কার ক্রীড়াদপ্তর কিংবা সেই খেলোয়াড়দের কোনো ক্ষতিকারক উদ্দেশ্য ছিল না। নিতান্তই হতদরিদ্র তারা, পরিবার-পরিজনের মুখের দিকে তাকিয়ে, বাঁচার জন্য এমন কাজ করেছে। জার্মানির ক্রীড়াপ্রধানের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠিও পাঠিয়েছিল কয়েকজন। অবশ্য কিছু বছরের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড় দেশে ফিরে আসে। অনেকেই ওখানে ভালো চাকরি পেয়েছিল, কয়েকজনকে ফিরতে হয় খালি হাতে। জীবনের থেকে বড়ো রহস্যময় আর কী আছে? সেই রহস্যের টানেই এত বড়ো ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিল তারা।

Powered by Froala Editor

Latest News See More