স্ল্যাং-এর উদাহরণ রয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যেই, বাদ যাননি বঙ্কিম-শরৎ, এমনকি বিবেকানন্দও

‘…তাও না থাকলেই আপদ চোকে। চুপ কর মাগি।’

না, এতে চমকানোর কিছু নেই। সাহিত্যে, বক্তব্যের প্রয়োজনে এমন ব্যবহার প্রাসঙ্গিক হতেই পারে। কিন্তু চমক লাগে তখনই, যখন জানতে পারি, এই সংলাপের লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর ঋষিপ্রতিম সৌম্য মুখটি। তাঁর কলম দিয়েই বেরিয়েছে ‘মাগি’ শব্দটি! এও কি সম্ভব!

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথকে ‘ব্যাঙ্গ’ করে কবিতা লিখলেন বনফুল, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিলেন গল্পের প্লট

হ্যাঁ, সম্ভব। শুধু একবার নয়, একাধিক ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন ‘মাগি’ শব্দটি। শুধু ‘মাগি’ই নয়, লিখেছেন ‘শালা’, ‘মিনসে’, ‘পোড়ারমুখী ডাইনি’-র মতো শব্দও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাতে ক্ষতি কী! লেখক যদি লেখার প্রয়োজনে স্ল্যাং ব্যবহার করেন, তাতে অসুবিধের কিছু নেই তো! সত্যিই নেই। বরং, কখনও-কখনও এই স্ল্যাংগুলি আরও বাস্তবসম্মত করে তুলেছে সেই সংলাপকে। চরিত্রের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও পরিস্থিতি তাকে দিয়ে স্ল্যাং বলিয়ে নিলে, তাতে গোঁসা হবেই বা কেন! কিন্তু ওই যে, বিস্ময় জাগে! রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাঙালির কাছে শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি, তাঁর কলম দিয়ে এমন স্ল্যাং বেরোলে, ‘ভক্তজন’ যে বিমর্ষ হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই বছরে জন্ম, বিস্মৃতির অতলে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

তবে, রবি-ডিফেন্সেরও সুযোগ রয়েছে প্রত্যেকক্ষেত্রেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও সচেতন ছিলেন এ-বিষয়টায়। ঠিক সেকারণেই, কোনো গদ্য বা ন্যারেশনে স্ল্যাং আনেননি তিনি। এড়িয়ে গিয়েছেন সচেতনভাবেই। রবীন্দ্রনাথের লেখায় স্ল্যাং এসেছে শুধুমাত্র চরিত্রগুলির সংলাপ হিসেবে। তাতে ঠাকুরের শুদ্ধতাও রইল, আবার চরিত্রগুলিও কৃত্রিমতার আশ্রয় নিল না।

নেয়নি কি? এমন উদাহরণও তো একাধিক, যাতে নিজের ‘শুদ্ধতা’র কারণে স্ল্যাংগুলিতেও ‘শান্তিজল’ ছিটিয়ে নিয়েছেন তিনি। উদাহরণ চাই? ‘চোখের মাথা খাওয়া’-কে তিনি ‘চক্ষুখাদিকা’য় বদলেছেন। ‘স্বামীর আয়ু খাওয়া’-কে ‘ভর্তার পরমায়ুহন্ত্রী’, ‘আটকুঁটির বেটি’-কে ‘অষ্টকুষ্ঠির পুত্রী’ – এমন কত কী! এমন সাধু স্ল্যাং-এ ভর্তসনাগুলো কমপ্লিমেন্টে বদলে গেছে কিনা, তা বিচারের দায় অবশ্য পাঠকের।

আরও পড়ুন
‘আমার বাকি লেখাগুলোয় সুর দিয়ো’, পঙ্কজ মল্লিককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

আরেকটি স্ল্যাং-এর সাধুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাও তাঁর নিজের লেখা নয়। সংগৃহীত ছড়া। তাতেও শব্দ বদলে দিয়েছিলেন তিনি। মূল ছড়ায় ছিল ‘ভাতারখাকী’ শব্দটি। রবীন্দ্রনাথ করলেন ‘স্বামীখাকী’। যুক্তি দিলেন, ‘সেই গালিটিকে অপেক্ষাকৃত অনতিরূঢ় ভাষায় পরিবর্তন’ করে দিয়েছেন তিনি।

তবে, স্ল্যাং মানে যে একমাত্র গালাগালি, তা নয়। বিশ্বের তাবড় ভাষাবিদরা স্ল্যাং-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিভিন্ন যুক্তি হাজির করেছেন। হতে পারে তা অপভাষা, হতে পারে চলিত কথার মধ্যেকার কোনো লঘু শব্দ – স্ল্যাং-এর আওয়ায় পড়ে সকলেই। আর, নিজস্ব ‘ইমেজ’ বা রুচিবোধের কারণে, রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন স্ল্যাং-কে, তাঁর লেখায়। তবু, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বেরিয়ে পড়েছে অবশ্যই।

আরও পড়ুন
এস্রাজে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ, শিক্ষক হিসেবে পেলেন ১৭ বছরের অশেষচন্দ্রকে

বরং বঙ্কিমচন্দ্র অনেক সহজ ছিলেন স্ল্যাং বিষয়ে। ‘মিনসে’, ‘হারামজাদী’, ‘মাগী’, ‘পোড়ারমুখী’, ‘আবাগি’, ‘শতেক খোয়ারী’ – ইত্যাদি শব্দ তাঁর লেখায় এসেছে অহরহ। অবশ্য চরিত্রের মুখেই, সংলাপের অংশ হিসেবে। তবে রবীন্দ্রনাথের তুলনায় বঙ্কিম অনেক কম রক্ষণশীল ছিলেন – এ-কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সমালোচকরাই।

প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্র – দুজনের লেখার বেশিরভাগ স্ল্যাং-ই এসেছে নারীর মুখের সংলাপ হিসেবেই। ব্যতিক্রম ছিলেন না শরৎচন্দ্রও। তাঁর ‘শুভদা’ উপন্যাসের একটি চরিত্রের সংলাপ – ‘ওরে হারামজাদি তোকে খাব… ওরে আবাগি – শতেকখোয়ারি – ছেনাল – ডাইনি… তোকে… খাব।’

আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে পড়াতে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে-সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা লীলার

ভাষা নিয়ে কোনো গোঁড়ামি ছিল না বিবেকানন্দের। তিনি লিখেছিলেন – ‘স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে? …স্বাভাবিক যে ভাষায় আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালোবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হ’তে পারেই না…’

তাঁর নিজের লেখাতেও সন্ন্যাসীসুলভ গাম্ভীর্য ছেড়ে বেরিয়েছেন অনেকবারই। ভাঁওতা, অষ্টরম্ভা, ঘোড়ার ডিম, ভেরেণ্ডা, শালা – ইত্যাদি মুখের শব্দগুলো অনায়াসেই উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। আবার, রামকৃষ্ণের সম্পর্কে একজায়গায় লিখেছেন – ‘ঠাকুর এই কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির বেটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন।’

আরও পড়ুন
সামনে যেন স্বয়ং যিশু, রবীন্দ্রনাথকে দেখে নতজানু লন্ডনের কফি বিক্রেতা

আসলে, সে-আমলে এমন অনেক শব্দ ছিল, যা তৎকালের সাপেক্ষে ‘স্ল্যাং’ ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ তা সহজ হয়ে এসেছে। আবার এমন অনেক শব্দ, যা তখন সাধারণভাবেই ব্যবহার করা হত, কালে কালে আজ তা ‘গালাগালি’র পরিচয় পেয়েছে। কাজেই এই আদানপ্রদান চলছেই। শুদ্ধতার কোনো একরৈখিক সংজ্ঞা হয় না। তেমনই মানে হয় না শব্দবন্ধের ব্যবহার, বিকৃতি ইত্যাদি নিয়ে তুমুল চর্চাও। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ সংলাপের মুখ দিয়ে স্ল্যাং বলিয়ে আপাত এক শুদ্ধতার গণ্ডি বজায় রেখেছিলেন। পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের কলমে ভেঙে গেছে সেই গণ্ডিও।

আরও পড়ুন
সিগারেটের কারখানা উদ্বোধন করবেন রবীন্দ্রনাথ, বানানো হল ফুলের তোরণ

কাজেই, কে কোন লেখা বিকৃত করল, আদৌ বিকৃত হল কিনা, সেটা তার নিজেরই লেখা নাকি অন্য কারোর লেখার ওপর ‘পাকামি’ – এসব বিতর্ক চলতে থাকবেই। যেমন হত প্যারোডি নিয়েও। এসব সরিয়ে, সহজ স্রোতের দিকে এগিয়ে চলাই ভালো। সময়ই ঠিক করে দেয়, কী থাকবে, আর কী হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। সময়ের হাতেই সব, আর কেউ না…

তথ্যসূত্র – বাংলা স্ল্যাং / অভ্র বসু
বাংলা স্ল্যাং – সমুচয় ঠিকুজিকুষ্ঠি / অজিত রায়

Powered by Froala Editor