সূচ দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় শিশুর বুক, ২৫০ বছরের পুরনো প্রথা আজও চালু ভারতে

মার্চ মাসের পুণ্য তিথিতে কেরালার মন্দিরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে উৎসব। ভিড় জমিয়েছেন বহু মানুষ। সেখানেই একটি শিশুকে ঘিরে আছেন পূজারীরা। শিশুটির গায়ে মালা, রং-বেরঙের বেশভুষা, কপালে তিলক। তাকেও বোধহয় পুজো করা হবে। ঠিক এখানেই ভুল হয়ে গেল। না, বাচ্চাটিকে পুজোর জন্য তৈরি করা হয়নি। বরং তাঁকে তৈরি করা হচ্ছে উৎসর্গের জন্য। যে উৎসর্গে 'তুষ্ট' হবেন ভগবান! একবিংশ শতকের ভারতে দাঁড়িয়ে আজও ভয়ংকর বাস্তব এটি। আর এই প্রথাটি পালিত হচ্ছে কোন রাজ্যে জানেন? কেরালা, ভারতের মধ্যে যে রাজ্যে শিক্ষিতের হার নাকি সবচেয়ে বেশি!

আরও পড়ুন
রং-তুলির সাহায্যে ক্যানভাস হয়ে উঠল গোটা গ্রাম, বাংলার ‘খোয়াব গাঁ’-এর গল্প

গোড়া থেকে শুরু করা যাক। মার্চ মাস নাগাদ কেরালার চেট্টিকুলাঙ্গারা মন্দিরে আয়োজিত হয় ‘কুম্ভ ভারানি’ উৎসব। দক্ষিণের কুম্ভ মেলা বলা হয় যাকে। সেই উৎসবেরই একটি অংশ হল চুরাল মুরিয়াল। প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা। বেশ ধার্মিক আবরণ থাকলেও, এই প্রথাটির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বীভৎসতা। দেবী ভদ্রকালীকে ‘সন্তুষ্ট’ করার জন্য ৮ থেকে ১৪ বছরের শিশুর রক্ত ‘বলি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই রক্তে নাকি দেবীও ‘প্রসন্ন’ হন, আর যে পরিবার তাদের সন্তানকে বলির জন্য পাঠাচ্ছে, তাদেরও মঙ্গল হয়!

আরও পড়ুন
ক্রিকেটের রমরমা সর্বত্র, হারাতে বসেছে গ্রামবাংলার ‘হাঁস ধরার প্রতিযোগিতা’

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। দেখা গেছে, এই পুজো যাঁরা করে থাকেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই ধনী পরিবারের। আরও আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা নিজের পরিবারের কাউকে এই বলির জন্য পাঠায় না। এর জন্যও তৈরি হয়েছে আলাদা একটি ‘প্রথা’। গরিব পরিবারগুলো থেকে তাঁদের ঘরের ছেলেকে দত্তক নেন তাঁরা। বিনিময় ওই পরিবার পায় কয়েক লাখ টাকা। তাঁরাও চুপ থাকেন। কুম্ভ ভারানি’র আগে থেকেই ওই বাচ্চাকে নাচের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। উৎসবের চরম মুহূর্তে, তাকে রীতিমতো রাজার পোশাকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে। এক ঝলক দেখে মনে হবে, বোধহয় পুজো করা হবে শিশুটির। যেমন আমাদের বাংলায় কুমারী পূজার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন
যুবতীর বেশে আসর মাতায় পুরুষরাই, বিলুপ্তির পথে গ্রামবাংলার ‘ছোকরা নাচ’

কিন্তু তখনই শুরু হয় আসল খেলা। বাচ্চাটির পাঁজরে গেঁথে দেওয়া হয় সূচ। তাতে পড়ানো থাকে সোনার সুতো। সেই অবস্থাতেই হাঁটিয়ে চেট্টিকুলাঙ্গারা মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। বাচ্চাদের আর্তনাদ, চিৎকার, বাঁচার আকুতি ঢেকে যায় ‘ভক্ত’দের শ্লোগান আর বাঁশির আওয়াজে। মন্দিরে পৌঁছনোর পর, দেহ থেকে ওই সূচ-সুতো বের করে নেওয়া হয়। ওই বাচ্চাদের রক্তে তুষ্ট করা হয় দেবতাকে। তাতেই ‘সন্তুষ্ট’ তিনি…

আরও পড়ুন
গ্রামবাংলার আমেজ নিয়ে, কলকাতার প্রেস ক্লাব চত্বরে হাজির ‘গ্রামকৃষ্টি উৎসব’

হ্যাঁ, এখনও এই বর্বর প্রথাটি চলে আসছে। বন্ধ করার চেষ্টা চলেছে প্রচুর। ২০১৬ সালে চুরাল মুরিয়ালকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেরালা স্টেট কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ডস। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কেরালা হাইকোর্টও এই প্রথাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কোথায় কি! সে সব নিষেধাজ্ঞায় কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না মন্দির কর্তৃপক্ষ। পাত্তা দিচ্ছে না ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোও। ২৫০ বছরের এই প্রথা বন্ধ হয়ে গেলে যদি দেবী রুষ্ট হন! স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও এই নিয়ে প্রায় চুপ। মন্দির কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা নাকি অনেক। সেই সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক দলের নেতারাও। ২০১৭ সালে রাজ্যসভার এক সাংসদ সুরেশ গোপীও এই প্রথা পালন করেছেন। মানে, বলি দিয়েছেন। কাজেই, ওসব আদালত, নিয়মকে বুড়ো আঙুল। নিয়ম চলছে নিয়মের মতো। আর ভুগছে গরীব বাচ্চারা।

আরও পড়ুন
মুঠপুজো – গ্রামবাংলার যে আদিম লক্ষ্মী-আরাধনায় শুরু হয় নবান্নের মাস

চুরাল মুরিয়ালে যে বাচ্চারা একবার ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে যায়, তাদেরই পরে সমাজ থেকে একপ্রকার ব্রাত্য করে রাখা হয়। তখন নাকি তারা ‘অশুভ’। সারাটা জীবন এই তকমা নিয়ে কাটাতে হয় তাদের। এইভাবেই শেষ করে ফেলা হয় একাধিক শৈশব। ভারত কি আদৌ আধুনিক হচ্ছে? এইরকম বিভিন্ন ঘটনায় সেই প্রশ্নটাই উঠে আসছে…