যে গানে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান সাঁওতাল মেয়েরা

"বন্ধু তোমার ভালোবাসায় থাকবো মাটির পিঞ্জিরায়..." 

বন্ধু, বন্ধুত্ব ছাড়া মানুষ বোধহয় নিজেকে ভাবতেই পারে না। সবার সঙ্গে, সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলতে চায় তার যাপন। বসবাস। কথার বলার সঙ্গী চাই, কথা শোনার সঙ্গী চাই – এই যে সাহিত্য, লেখালেখি তাও তো একজন লেখক চান একজন পাঠককে যিনি রচনাটিকে ভাগ করে নেবেন নিজের সুখ দুঃখের সঙ্গে। পাঠকের মধ্য দিয়ে কিংবা রচনাটি ব্যক্তিগত মাধ্যম ছাড়িয়ে পৌঁছে যেতে চায়, খুঁজে ফেরে অন্য একজন সঙ্গীকে। তাই হয়তো কোনো লেখক কিংবা কবি নিজেকে আড়ালে রেখে, নিজে নির্জনে থেকেও চান,  তাঁর কবিতা, লেখা সেই নির্জনতার ভাষা পৌঁছে দিন অপর একজন সঙ্গীর কাছে। মাধ্যম হয়ে উঠুক। নিঃসঙ্গ একাকী মানুষটিও তাই নিজের কথাগুলোকে সঞ্চয় করে রাখে ডাইরির পাতায়। যুগ যুগের ইতিহাস এই বলে আসছে, সঙ্গী চাই, বন্ধু চাই। 

সেরকমই আমাদের শেকড়ের গান, লোকগীতির একটা ধারা হচ্ছে, 'পাতাগীত'। 'পাতা' মানে 'পাতানো'। আগে যেমন সই পাতানো হত, এখন যেমন বন্ধুত্ব করা হয়। কিংবা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়ে একে অপরকে, এটাও অনেকটা তাই। একটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের আবেদন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত।  হৃদয়ের কথা নিয়ে, হৃদয়কে শোনানোর জন্য এই পাতাগীত রচনা করা হয়। পাতাগীত বন্ধুত্বের আবেদন নিয়ে রচিত হলেও, যুবক যুবতীরা প্রেমের বিশুদ্ধতায় গানগুলো গেয়ে থাকেন। তাই গানগুলোর ভাষা,  সুর খুবই আবেগপ্রবণ।  জীবনের সুর নিয়ে সবুজ মাঠের ভেতর মাদলের তালে তালে সবুজ যুবক যুবতীরা পাতাগীত গেয়ে বন্ধুত্ব করেন। 

বন্ধুত্ব করার জন্য যেমন কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, স্থান নেই 'পাতা উৎসবে'ও তাই। গ্রামের মধ্যে কোনো খোলা মাঠে, কিংবা আখড়ায় এই অনুষ্ঠানের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়। আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয় সময় ওদিন।  গ্রামের সব যুবক যুবতীরা ওইদিন জড়ো হন। নাচ এবং গানের মাধ্যমে বন্ধুত্বের আবেদন জানানো হয়। সোনালি মায়ায় ঝরে পড়তে থাকে গানের সুর। আবেগ।  প্রতিটি গানই ভণিতাহীন। সহজ সরল ভাষায় রচিত। সাধারণত মেয়েরা মুখে মুখে এই গান বানান, গেয়ে থাকেন। চার থেকে পাঁচ লাইনের গান। মাদলের তালে তালে আখড়া তখন নেচে ওঠে...  সুরে ভাসে...

"সনাগাঢ়ার ফুলমণি 

জামশোলের শাড়ি পরিল

যাবার বেলা চোখ দিয়া 

লোহ গড়াইল" 

  – সোনাগাড়ার গাঁয়ের মেয়ে ফুলমণি জামশোলের শাড়ি পরেছিল। কিন্তু যাওয়ার সময় তার চোখ দিয়ে জল পড়ল। 

গানটিতে বন্ধুকে বিদায় দেওয়ার সময় কষ্টের ছবিটি ফুটে উঠেছে। অভিমান, কষ্ট, বন্ধুকে ছেড়ে থাকার যে আবেগ তাই তার চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। 

ঝাড়খণ্ডের ধলভূম অঞ্চলে 'পাতাগীত' বা পাতাউৎসবের মধ্য দিয়ে যুবক যুবতীরা আবার জীবনসঙ্গীকেও বেছে নেন। গানের মাধ্যমে প্রিয় পুরুষটিকে জানান তার মনের কথা। পুরুষ বন্ধুটি তখন মাদল বাজিয়ে,  মাদলের তালে তালে নেচে উঠেন। তখন রঙ ধরে প্রকৃতির মনেও। ময়ূরের পালক পরা মাথা লজ্জায় নত হয়। লাল টুকটুকে হয়ে ওঠে মেয়েটিও। গানের মধ্য দিয়ে নতুন এক সংসারের স্বপ্ন গাঁথে তারা। 

যেমন –

"গাছ ভারি পাতা ভারি 

তুমার মন রে ভারি; 

হাতের শাঁখা নুয়া পরিব 

তুমার মন পাইব" 

আবার –

"হাতে লিব সুরু শাঁখা 

পায়ে লিব মল রে 

বাইরাব ঝামারে ঝুমুরে 

নাচিব দিশুয়া তালারে"...