এতদিন তাঁদের ‘অচ্ছুৎ’ হিসেবে দূরে সরিয়ে রেখেছে সমাজ। এতদিন কেন শুধু, হয়তো আজও। ন্যাশানাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী, রক্ত দিতে পারেন না রূপান্তরকামীরা। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞাকে দূরে সরিয়ে, রক্তদানে এগিয়ে এলেন তাঁরা। শুধু কলকাতাই নয়, সম্ভবত এমন ঘটনা ভারতে প্রথম। আর কোনো কমার্শিয়াল ব্লাড ব্যাঙ্ক নয়, অংশ নিল লায়নস ব্লাড ব্যাঙ্কের মতো অলাভজনক সংস্থা। সব মিলিয়ে, রক্তদানের মঞ্চে আরও একটি বিপ্লবের জন্ম দেখল শহর।
শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীতেই এলজিবিটি কমিউনিটির মানুষদের রক্তদানের ওপর জারি রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সেই অচলায়তন কাটিয়ে ওঠার জন্যে ইন্টারন্যাশানাল রেড ক্রস সোসাইটি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কীভাবে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্তদানে যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে তারা। সেই উদ্যোগে ভারতের পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ এই রক্তদান শিবির।
গত রবিবার, ‘বিশ্ব যুব দিবস’ উপলক্ষে মাতৃভূমি স্টুডেন্টস সোসাইটি’র উদ্যোগে মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে রক্তদান শিবির আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেই যোগ দেন এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষরা। সম্ভবত ভারতে প্রথম এমন উদ্যোগ নেওয়া হল। লায়ন্স ব্লাড ব্যাঙ্কের তরফ থেকে সেই রক্ত সংগ্রহও করা হয়েছে।
ভারতের ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো) এবং ন্যাশনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিলের (এনবিটিসি)-এর নিয়ম অনুযায়ী, ট্রানজেন্ডাররা রক্ত দিতে পারবেন না। কারণ, তাঁদের মধ্যে এইচআইভি-তে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই বেশি। আর এই ব্যাপারে সমাজের কিছু 'কুসংস্কার'ও জড়িয়ে রয়েছে। অথচ সবাই যে এইচআইভি-আক্রান্ত, তাও কিন্তু নয়। আর তা নিয়েই ট্রান্সজেন্ডারদের জিহাদ। সেই আগল থেকে বেরিয়ে এসে, সেই মানসিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁদের এই উদ্যোগ।
এই প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অফ বেঙ্গলের সদস্যা রঞ্জিতা সিনহা প্রহরকে জানিয়েছেন, “ন্যাকো আর এনবিটিসি-এর মতো সংস্থা কেমন করে ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটিকে একঘরে করে রাখে এগুলো দেখিয়ে। এটা তো একরকমের ভায়োলেন্স। একটা গোষ্ঠীর সবাই তো এইচআইভি পজিটিভ হতে পারে না! এরকমভাবে প্রতিবার কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে আমাদের। আজ এই রক্তদান শিবির সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি কতটা বদলাতে পারবে জানি না। তবে চেষ্টাটা শুরু হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডাররাও যে মানুষ, অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মতো তাঁরাও যে রক্ত দিতে পারেন, সেই ধারণাটাই গড়ে তুলতে হবে।”
এরকম একটা ঘটনা এতদিনের অচলায়তনকে নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে খুবই কার্যকরী। ট্রান্সজেন্ডার মানেই যে শরীরে একটা মারণ অসুখের বীজ নিয়ে ঘুরছেন, এবং রক্তও নিষিদ্ধ, এই যে একটি ‘কুসংস্কার’, এই ধারণার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিতে পারে এই রক্তদান।
এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও ট্রান্সজেন্ডার মানুষরা সমাজের নানা অংশে নিগৃহীত হন। রামধনু উড়লেও, এখনও প্রতিটা মুহূর্তে অস্তিত্বের জন্য, অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয় তাঁদের। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত নিয়ম ঠিক থাকলে, একজন সমকামী বা রূপান্তরকামী মানুষ কেন পারবেন না রক্ত দিতে? হয়তো এ-নিয়ে বিতর্কও হবে। কেননা এখনও এটি আইনের পরিপন্থী। এই ঘটনার ফলে আইন ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে, নাকি অন্যকিছু - তা অবশ্যই সময়ের হাতে। তবে মানুষের পরিচয় যে তাঁর কাজে, মনুষ্যত্বে, ধর্মে-লিঙ্গে-জাতিতে নয়, সেই কথা জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে আজ। আর সেখান থেকেই এই পদক্ষেপ।