ক্রেতা নেই, বন্ধ মুখোশ-নির্মাণও, লকডাউনে খাঁ-খাঁ করছে পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রাম

মধ্য জানুয়ারির হিমেল পরশে পুরুল্যায় আসে উৎসবের মরশুম। পৌষের অন্তে সংক্রান্তি পরব। টুসুর চৌড়ল ভাসান দিতে মজা নদীর ধারে ভিড় জমান স্থানীয় মানুষ। গ্রামীণ মেলার টানে মফঃস্বলের ধূসর রাস্তা তখন ছুটির আলিস্যি মেখে পড়ে থাকে। আশেপাশের দোকানপাটে ঝোলে তালা। দোকান-মালিকদের বাড়িতে হয়তো তখন পালিত হচ্ছে আখাইন যাত্রার আচার-অনুষ্ঠান।

ওই সময়ে বাঘমুণ্ডি ব্লকের চড়িদায় গিয়ে অনুভব করেছিলাম, চড়িদা কিন্তু ছুটির মেজাজের মাঝেও খানিক ব্যতিক্রম। সেখানে রোজকার ব্যস্ততায় কোনো খামতি ছিল না। এপারে-ওপারে সার সার মুখোশের দোকান। নিজেদের বাড়ির চৌহদ্দিতেই নিরন্তর শিল্পের চর্চা করে চলেছেন শিল্পীরা। কারও সামান্য একচিলতে ঘুপচি ঘর, কেউ বা অনেক খোলামেলা জায়গা জুড়ে কাজ করছেন। কেউ খুব গোছানো, কারও সারা দোকান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া কাগজ, রঙের বাটি, লোহার তার। শিল্পীর অধ্যবসায়ের কাছে এসে সেসব বিভেদ ঘুচে যায়। সকালের রোদ-মাখা সিমেন্টের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দিব্যি চোখে পড়বে – কেউ হয়ত মুকুটে জড়ির পাড় লাগাচ্ছেন, কেউ বা কাদামাটির সমন্বয়ে সবে শুরু করেছেন ছাঁচ ঢালা।

বাঘমুণ্ডি থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম এখন আন্তর্জাতিক মহলেও যথেষ্ট সুপরিচিত। বিশেষত, ২০১০ সালে ইউনেস্কোর ‘Intangible Cultural Heritage of Humanity’-র তালিকায় ছৌ নাচের অন্তর্ভুক্তির পর বিশ্বের দরবারে আরও বেশি করে পরিচিত হয়ে উঠেছে এই মুখোশের অভিনবত্ব। ২০১৬ সালে ছৌ মুখোশের মুকুটে জুড়েছে জিআই ট্যাগ। প্রসঙ্গত, পুরুল্যার ছৌ ছাড়া আরও যে দুই ঘরানার ছৌ প্রচলিত, তার মধ্যে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ ছৌ নাচে মুখোশের কোনো ব্যবহার নেই, আর ঝাড়খণ্ডী সেরাইকেলার ছৌ-য়ে মুখোশ থাকলেও তা কেবলই প্রতীকী। আঙ্গিকের দিক থেকে ময়ূরভঞ্জ ও সেরাইকেলা দুই ঘরানার ছৌ নাচেই বেশ কিছু মিল রয়েছে। মুখোশের বদলে ওড়িশার ছৌ শিল্পীরা মুখে রঙের প্রলেপ ব্যবহার করেন। সেদিক থেকে পুরুল্যার ছৌ অনেক বেশি স্বতন্ত্র। সেখানে মুখোশের ব্যবহার অবাধ, যে কারণে কেবলমাত্র শরীর সঞ্চালনের মাধ্যমে সমস্ত আবেগ ফুটিয়ে তোলার মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করতে হয়। তা একইসঙ্গে কঠিন, আবার গর্বেরও। আর এইখানেই লুকিয়ে থাকে চড়িদার মুখোশ-কারিগরদের মাহাত্ম্য।

দুটি বুথ মিলিয়ে গ্রামে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বসবাস। পেশার দিক থেকে বেশিরভাগই সূত্রধর সম্প্রদায়ভুক্ত। মূলত তাঁরাই এই মুখোশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাস অনুযায়ী, প্রায় ২০০ বছর আগে বাঘমুণ্ডির রাজারা চড়িদায় নিষ্কর জমি কিনে প্রতিমা নির্মাণের জন্য সূত্রধরদের নিয়ে আসেন। রাজবাড়ির প্রতিমা নির্মাণ করতে করতে একসময় এই মুখোশ তৈরির কৌশল তাঁরা নিজেরাই আবিষ্কার করেন। প্রথমে নানা পৌরাণিক চরিত্রের মুখের আদলে মুখোশ তৈরি করা শুরু করেন। যেহেতু পুরুল্যার ছৌ শিল্পীরা মুখোশ পরে নাচেন, সেহেতু মুখোশের মধ্যেও মানবমনের অন্তরাত্মাটি যথাসম্ভব ফুটিয়ে তুলতে হয় মুখোশ-শিল্পীকে। এখন পৌরাণিক চরিত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে নানা বন্যপ্রাণীর মুখোশ, অপদেবতা, শহুরে বিনোদনের সুপারহিরো, এমনকি অন্যান্য ধ্রুপদী লোকনৃত্য যেমন মণিপুরি, কথাকলি, কুচিপুরির মুখোশ তৈরিতেও হাত পাকিয়েছেন শিল্পীরা। পেশার প্রয়োজনীয়তার চেয়েও এই যাপনে যেন অনেক বেশি জড়িয়ে আছে বংশ-পরম্পরায় পাওয়া ভালবাসার টান। তাই তো বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে কচিকাঁচারাও বসে যায় মুখোশ সাজাতে।

কিন্তু এই বাধ্যতামূলক বন্দিদশায় হার মানতে হয়েছে কর্ম-শান্ত এই গ্রামকেও। আণুবীক্ষণিকের চোখরাঙানিতে বন্ধ হয়ে গেছে মুখোশ তৈরির কাজ। ঝাঁপ পড়ে গেছে দোকানে। ‘আদর্শ মুখোশ দোকান’, ‘হীরালাল মুখোশ ঘর’, ‘দূর্গাচরণ ছৌ মুখোশ সেন্টার’ লেখা সাইনবোর্ডগুলোয় ধুলো জমছে। কবে সব আবার স্বাভাবিক হবে, কিছুই বুঝতে পারছেন না তাঁরা। কথা হচ্ছিল শিল্পী ত্রিগুণী সূত্রধরের সঙ্গে। চড়িদা থেকে ফোনেই প্রহরকে জানালেন তাঁদের বর্তমান অবস্থার কথা – ‘এখানে সবই এখন বন্ধ। চাষবাস যারা করে, তাদেরও চাষের কাজ বন্ধই বলতে গেলে। আমাদের তো কাজ বন্ধই, বিক্রিবাটার তো কোনো প্রশ্নই নেই। নিজেদের যা সামান্য সঞ্চয় আছে, সেসব ম্যানেজ করে কোনোমতে চলছে। তবে মুখ্যমন্ত্রী ওই রেশনের ব্যবস্থা করেছেন, সেটা আমরা ফ্রি পাচ্ছি। জঙ্গলমহলে সার্ভিসহোল্ডার ছাড়া এখানকার সকলেই ওই রেশনটা পাচ্ছেন। তাতে কিছুটা হেল্প হচ্ছে। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী যোজনা থেকে মেয়েদের পাঁচশো টাকা করে হাতখরচ আসছে, তা দিয়ে কিছুটা চলছে। কিন্তু লকডাউন যদি আবার বাড়ে, তাহলে তো খুবই সমস্যায় পড়ব।’

ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে ছৌ শিল্পীরা মুখোশ নিতে এই চড়িদাতেই আসেন। এছাড়া, ক্রেতাদের একটা বড় অংশ হলেন পর্যটকরা। যদিও এই সময়ে সেরকম পর্যটক সমাগম হয় না, তাও শনিবার-রবিবারের ছুটিতে যে দু-একজন আসতেন, তাঁদেরও এবছর আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এছাড়া, বিভিন্ন জেলাভিত্তিক মেলা, ভিনরাজ্যের শিল্পমেলাগুলিতেও এখান থেকে মুখোশের সম্ভার নিয়ে পাড়ি দেন শিল্পীরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তাঁত ও হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ব বাংলা’-র বিভিন্ন বিপণিতেও শোভা পায় চড়িদার মুখোশের সারি। গরমের শুরুর এই সময়ে তাঁরা মূলত নতুন কাজ শুরুর পরিকল্পনা করেন। লকডাউনের কল্যাণে কোনোকিছুরই নিশ্চয়তা নেই। আবার কবে কাজ শুরু করতে পারবেন, সে নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ঝরে পড়ে ত্রিগুণীর গলায় – ‘আমরা তো এখানে কেউ চাকরি-বাকরি করি না, আমাদের নিজস্ব কর্মের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হয়। কর্ম বন্ধ হয়ে গেলে আমরা একেবারে অসহায়। তাছাড়া, শুধু তো খাওয়া-পরা নয়, ছেলেপুলের লেখাপড়ার ব্যাপার আছে, সেসব কীভাবে হবে, জানি না। দেখা যাক।’

ত্রিগুণী এবং তাঁর দাদা ফাল্গুনী এই চড়িদা গ্রামের গর্ব। রাজ্যস্তরে মুখোশের প্রতিযোগিতায় একসময়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ত্রিগুণী। দিল্লি, মুম্বাই, গুয়াহাটিতে আয়োজিত নানা আন্তর্জাতিক শিল্প মেলায় আমন্ত্রণ পেয়েছেন তাঁরা। গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে নরওয়ের ট্যান্ডেমে ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন দুই ভাই। বস্তুত, তাঁদের কাজ খুঁটিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্য, তুলির সূক্ষ টান। একশো বছর আগে যে ধরনের ছৌয়ের মুখোশ তৈরি হত, সেই ‘কামরাঙা তাজ’ শিল্পরীতির যে কয়েকজন এখনও হাতে গোনা শিল্পী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এঁরা অন্যতম। মুকুটের নক্সায় কামরাঙা ফলের আলংকারিক সাদৃশ্য থাকায় এমন নাম। খুব নিপুণ হাতের টান না হলে এই ধরনের কাজ সম্ভব নয়। এমন শিল্পীকেও এখন বাধ্য হয়েই শিল্পকে ছেড়ে থাকতে হচ্ছে। অর্থসংস্থানের চিন্তার চেয়ে এই ছেড়ে থাকা যেন আরও যন্ত্রণাকর। অসহায়তা ঝরে পড়ে ত্রিগুণীর গলায় – ‘কাজ না করে হাঁপিয়ে উঠছি। কিন্তু কী করব, কোনও উপায় তো নেই। ওই ঘরের ভিতরে বসে মাঝে মাঝে রং-তুলির কাজ করছি, কিন্তু দোকানে না বসলে সেই ইন্টারেস্ট আসে না। সময় কাটানোই এখন কষ্টকর হয়ে উঠছে। শিল্পী যখন কাজ করে, কখন সকাল হয় বা কখন বিকাল হয়, তার কিছু খেয়ালই থাকে না। আর এখন সময়ই যেন কাটতে চাইছে না।’

কিছু মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের কারণে প্রান্তিক মানুষদের শিকার হওয়ার পরিসংখ্যান, রাজনীতিকদের বহুমুখিতা, ফোরফ্রন্টে থাকা স্বাস্থ্যকর্মী, গবেষকদের অসম লড়াই – এসবের মাঝে ত্রিগুণীদের মতো এই কাজপাগল মানুষগুলোর কর্মহীনতার অসহায়ত্বও থেকে যাক করোনা-আক্রান্ত এই ক্রান্তিকালের প্রতীকী দলিল হয়ে।

(চড়িদার বর্তমান অবস্থার ছবিগুলি পাঠিয়েছেন বিশাল সূত্রধর)

More From Author See More