বিশ্বের প্রথম ‘সেলিব্রিটি’ তিনি, রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রার সমাধির খোঁজ মেলেনি আজও

ইতিহাস কত গল্পই না আমাদের সামনে নিয়ে আসে! সেখানে কখনও থাকে হারিয়ে যাওয়া, কখনও প্রেম, বিরহ, বিশ্বাসঘাতকতা; আবার এই সবকিছুর সঙ্গে কখনও জুড়ে থাকে রহস্য। একটার পর একটা স্তর পেরিয়ে সেই রহস্যের মূল বিন্দুটার কাছেই তো পৌঁছতে চান ঐতিহাসিকরা। আর আমরাও অপেক্ষায় থাকি অজানা কোনো গল্পের। এত গৌরচন্দ্রিকা করার কারণ, ইতিহাসের যে চরিত্র আর যে প্রেক্ষাপট আজ আমাদের সামনে আসবে, যুগ যুগ ধরে আপামর পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন তাঁরা। সিনেমা, নাটক, উপন্যাস, গল্প— সবেতেই উজ্জ্বল উপস্থিতি তাঁদের। মিশরের সভ্যতা আর সাম্রাজ্যের কথা আসবে, আর ক্লিওপেট্রা আসবেন না - তা কি হয়! ইতিহাসের রহস্যময়ী রানি তিনি; যে গল্পেই এসেছেন রহস্য বাড়িয়েছেন। সঙ্গে বাড়িয়েছেন সৌন্দর্য।

সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম একটা কথা বলেছিলেন— আমরা যদি পৃথিবীর যাবতীয় বিখ্যাত ব্যক্তিদের দেখি, তাহলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ক্লিওপেট্রা বিশ্বের প্রথম সার্থক ‘সেলেব্রিটি’। সমস্ত দিক থেকেই এই কথাটি কতটা সত্যি, সেটা তাঁর জীবনী পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু একটা ছোটোগল্প যেমনভাবে শেষ হয়, রানি ক্লিওপেট্রাও যেন সেইভাবেই মিলিয়ে গেলেন। আজকের ঐতিহাসিক পৃথিবীতে এত ‘সেলেব্রেটেড’ তিনি, অথচ তাঁকে খুঁজে পাওয়ার কোনো উপায় নেই! তাঁর মৃত্যুও যেমন রহস্যের; তেমনই ধোঁয়াশায় তাঁর অন্তিম স্থানও। মৃত্যুর পর কোথায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে, প্রাচীন মিশরীয় রীতি অনুযায়ী কোনো মমি আছে কি তাঁর? অন্ধকারে ইতিহাস…

ক্লিওপেট্রার আকর্ষণ কোথায়, সেটা তাঁর গোটা জীবনই বলে দেবে। মিশরের শেষ ক্ষমতাবান ফ্যারাও তো বটেই, টলেমি বংশের শেষ সম্রাজ্ঞীও বটে। গ্রিক ও মিশর, দুই রক্তই তাঁর শরীরে বইছে। যে সময় ক্লিওপেট্রা ইতিহাসের মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তখন মিশরের রাজনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। রোমানদের প্রতিপত্তির সময় তখন; স্বাভাবিকভাবে নজরে পড়ল মিশরের দিকে। আর প্রাচীন মিশর তখন একটু একটু করে বদলেও যাচ্ছে। রাজসভায় ইজিপ্টের ভাষা ব্যবহৃত হয় না। তার বদলে প্রবেশ করেছে গ্রিক আচার-ব্যবহার। সেখানে ক্লিওপেট্রা সাদরে বরণ করে নিলেন মিশরের প্রাচীনত্বকে। তিনিই টলেমি বংশের একমাত্র শাসক যিনি নিজের ইচ্ছায় মিশরীয় ভাষা শিখেছিলেন।

ক্লিওপেট্রার কথা এলে আরও দুজনের নাম অবধারিত ভাবে আসবে। জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক অ্যান্টনি। সেই সময় রোমান সাম্রাজ্যের দুই সর্বশক্তিমান পুরুষ। এই দুজনকে কীভাবে নিজের ‘প্রেমিক’ বানিয়ে নিলেন ক্লিওপেট্রা, সেই ঘটনা গল্পে-নাটকে-সিনেমায় বর্ণিত। ইতিহাসও তার সাক্ষী। দুজনের সঙ্গেই রানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এমনকি এদের সন্তানেরও জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যদি প্রেমিক বলা হয়, তাহলে অনেক ঐতিহাসিক মার্ক অ্যান্টনির দিকেই আঙুল তুলবেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যিনি ছিলেন ক্লিওপেট্রার একান্ত আপন। তখনকার দিনের অনেক লেখা, প্যাপিরাস ক্লিওপেট্রার অসাধারণ মোহময়ী রূপের কথা সামনে নিয়ে এসেছে। শুধু রূপই নয়, তাঁর চরিত্রের আবেদনও এড়িয়ে যেতে পারত না অনেকেই। আর সেটাই ছিল ক্লিওপেট্রার আসল ‘ক্যারিশমা’।

ভাবুন, এমন জীবন কি কোনো চিত্রনাট্যের থেকে কম ছিল? কিন্তু তখনকার মিশরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। সিজারের অকস্মাৎ মৃত্যুর (পড়ুন, হত্যা) পর অগাস্টাস অক্টাভিয়ান ক্ষমতা দখলের জন্য সরাসরি মাঠে নামল। আর এই সূত্রেই মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে তাঁর সংঘাত উপস্থিত হল। এটা হতই, কারণ সিজারকে সরিয়ে রাখলে সেই সময় রোমে তাঁর সেনা জেনারেল অ্যান্টনিই ছিলেন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কাজেই, সিংহাসনের লড়াই এলে তো এই দ্বন্দ্বও আসবে। কিন্তু এর শেষটা হয় বিয়োগান্তকভাবে। আর সেটাই আমাদের পৌঁছে দেয় আরও একটা বড়ো রহস্যের কাছে। মার্ক অ্যান্টনি নিজের তরোয়াল দিয়েই আত্মহত্যা করেন। যখন অগাস্টাস আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করেন, তখন প্রাসাদে বসে নিজেও আত্মহত্যা করেন ক্লিওপেট্রা। শেষ হয় ইতিহাসের টানটান একটি চিত্রনাট্যের।

কিন্তু ওই যে, শেষ হইয়েও হইল না শেষ। ক্লিওপেট্রা নিজেই যে ছিলেন রহস্যময়ী। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন, আর প্রামাণ্য কোনো নিদর্শন নেই। শুধু রয়েছে প্যাপিরাসের কয়েকটা হায়রোগ্লিফিক ছবি; আর সেই সময় প্রচলিত কিছু মুদ্রা। তিনি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন, সেটাও রহস্যের আড়ালে। বিষাক্ত সাপের ছোবল খেয়ে, নাকি বিষ খেয়ে? আত্মহত্যা করেছিলেন, সে ব্যাপারে অবশ্য নিশ্চিত সবাই। এরপরই আসে আসল প্রশ্ন। তাঁর মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টি কোথায় হয়?

হিসেব অনুযায়ী, দুটি পদ্ধতিতে তাঁর শেষকৃত্য হতে পারে। এক, মিশরের চিরন্তন ‘মমি’ করে সমাধি; নয়তো সাধারণ কবর দেওয়া। এখানেই আসল রহস্য। কারণ, এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যেখান থেকে বলা যায় এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল ক্লিওপেট্রাকে। তবে সেই সময়ের বেশ কিছু রোমান ঐতিহাসিকদের মতে, মার্ক অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা দুজনকে একইসঙ্গে কবর দেওয়া হয়। বর্তমানে ঐতিহাসিকদের একাংশ এটাই মনে করেন, কারণ অ্যান্টনির সমাধিও পাওয়া যায় না।

যে মানুষটি সেই প্রাচীন সময় থেকে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চল্লিশ) আজও এত বিখ্যাত, যার সৌন্দর্য ও আকর্ষণ মিথের পর্যায় চলে গেছে; স্বয়ং শেক্সপিয়রকেও মোহিত করেছে, তাঁর কোনো খোঁজ নেই! বলতে গেলে, ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয় মিশর সভ্যতার বহমান ধারা। তাঁর এত ধন দৌলত, সেসবও পাওয়া যায় না। হয়ত তাঁর সমাধির সঙ্গেই রয়েছে। নীল নদ অববাহিকা ও ইজিপ্টের নানা জায়গায় ঐতিহাসিকরা খোঁজ চালিয়েছেন। টোম্ব অফ ক্লিওপেট্রা, বলা হয় যেখানে জীবনের শেষ মুহূর্তে ছিলেন রানি, সেখানেও বিস্তর খোঁজ করা হয়। সেই সময়ের রোমান লেখা, মিশরীয় প্যাপিরাস যা কিছু এখনও অবধি পাওয়া গেছে কিছু তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু হা হতোস্মি!

ঐতিহাসিকরা এই হারিয়ে যাওয়া ‘হাই প্রোফাইল’ সমাধির একটি নামও দিয়েছেন; টোম্ব অফ অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। অবশ্য এর একটি ভিত্তিও আছে। প্লুটার্ক, সুয়েটোনিয়াস প্রমুখ রোমান ঐতিহাসিক যারা ওই সময়ের একটা বর্ণনা রেখে গেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন অগাস্টাস নিজে নির্দেশ দিয়েছিলেন দুজনকে একসঙ্গে সমাধি দেওয়ার। সেখান থেকেই এই টোম্বের উৎপত্তি। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না।

ঐতিহাসিকদের আরও একটি সন্দেহ, এই সমাধিক্ষেত্রটি হয়তো জলের তলায় চলে গেছে। প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া নগর, যেটা ক্লিওপেট্রার রাজধানী ছিল, সেটি এখন সমুদ্রের ২০ ফুট নিচে। সেই ধংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেলেও, ওখানে সমাধি খোঁজার প্রক্রিয়া সেভাবে শুরু হয়নি। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছেন সেই রহস্যময়ী রানি। পাশেই শুয়ে আছেন তাঁর প্রেমিক। সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে এসে, একসঙ্গে খানিক নিরালাতেই কাটছে মৃত্যু পরবর্তী জীবন। শেক্সপিয়রের ভাষায়-
“She shall be buried by her Antony:
No grave upon the earth shall clip in it
A pair so famous.”

Powered by Froala Editor