তিন মহাদেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর ‘শেষতম’ মিউজিয়াম

দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণে ছোট্ট দ্বীপ দক্ষিণ জর্জিয়া (South Georgia)। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আন্টার্কটিকা – এই তিন মহাদেশেরই মোটামুটি মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপ। তবে আজও তা ব্রিটিশ শাসনাধীন। হবে নাই বা কেন? দক্ষিণ জর্জিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। কারণ আজও সেখানে কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই। শুধু পর্যটকরা মাঝে মাঝে ঘুরতে যান। আর সেই পর্যটকদের জন্যই রয়েছে আস্ত একটি মিউজিয়াম। হ্যাঁ, সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত মিউজিয়াম এটি। চারপাশে আর কোথাও মানুষের চিহ্ন নেই। তার মধ্যেই গত ৩০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মিউজিয়াম। করোনাকালে দীর্ঘদিন মিউজিয়াম (Museum) বন্ধ থাকার পর গত মাসেই আবার খুলে গিয়েছে সেটি।

দক্ষিণ জর্জিয়ার বুকে প্রায় পরিত্যক্ত শহর গ্রিটভাইকেন। সেখানেই অবস্থিত এই মিউজিয়াম। কিন্তু এমন একটা পাণ্ডববর্জিত এলাকায় কেন মিউজিয়াম তৈরি হল, জানতে গেলে এই শহরের ইতিহাস জানতে হবে। গ্রিটভাইকেন আজ পরিত্যক্ত শহর হলেও একসময় এখানে স্থায়ীভাবেই বাস করতেন বেশ কিছু মানুষ। অবশ্য তাঁরা সবাই এসেছিলেন ইউরোপ থেকে। আঠেরো শতকে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুক প্রথম ঘাঁটি গাড়েন দক্ষিণ জর্জিয়ায়। সেই থেকেই তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। তবে ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যের সীমানা তো তখন নেহাৎ কম নয়। এই জনহীন দ্বীপটি নিয়ে তাই মাথা ঘামায়নি প্রশাসন। কিন্তু বিশ শতকে সুইডিস সরকারের নজরে পড়ে দ্বীপটি। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই ১৯০৪ সালে তাঁরা এই দ্বীপে তিমি শিকার শুরু করেন।

গ্রিটভাইকেন শহরই ছিল সেই তিমি শিকারের মূল কেন্দ্র। আশেপাশের সমুদ্র উপকূল থেকে তিমি শিকার করে এনে এখানে তার মাংস এবং অন্যান্য দেহাংশ প্রক্রিয়াকরণ করা হত। ইউরোপের নানা দেশেই তখন তিমির মাংসের, তিমির যকৃতের তেলের বেশ চাহিদা ছিল। প্রায় ৬০ বছর রমরমিয়ে চলেছিল ব্যবসা। তারপর একদিন সারা পৃথিবীতেই তিমি শিকার নিষিদ্ধ করল জাতিপুঞ্জ। ফলে দক্ষিণ জর্জিয়ায় থাকারও আর কোনো প্রয়োজন থাকল না। ষাটের দশক থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল এই শহর। আবার নব্বইয়ের দশকে এসে ব্রিটিশ সরকার সেখানে প্রশাসনিক শাসন কায়েমের চেষ্টা শুরু করে। ততদিনে প্রায় সমস্ত বাড়িই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কেবল তিমি শিকার কেন্দ্রের ম্যানেজারের বাড়িটি ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় পড়ে ছিল। তাই নিয়ে কী করা হবে ভাবতে ভাবতেই এসে যায় পরিকল্পনা।

এভাবেই ১৯৯২ সালে তৈরি হয় দক্ষিণ জর্জিয়ার মিউজিয়াম। উনিশ ও বিশ শতকের ইউরোপীয় অধিবাসীদের নানা চিহ্ন সংরক্ষণ করে রাখা আছে সেখানে। আর আছে প্রাণী সংগ্রহশালা। অতিকায় সিল থেকে শুরু করে নানা হিংস্র সামুদ্রিক প্রাণীরও দেখা মেলে সেই সংগ্রহশালায়। তবে শুধু সংগ্রহশালা তৈরি করলেই তো হবে না। তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও তো কাউকে চাই। শুরু হয় কর্মচারী নিয়োগ। আর প্রথমেই বেছে নেওয়া হয় জেইন পিয়ার্সকে। ভূতত্ত্বের ছাত্রী জেইন চেয়েছিলেন আন্টার্কটিকায় গিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ সরকার কোনো মহিলা গবেষককে আন্টার্কটিকায় যেতে দিতে রাজি ছিল না। এমন সময়েই এসে যায় এই মিউজিয়ামের কিউরেটর হিসাবে যোগদানের প্রস্তাব। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান জেইন।

আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম রক মিউজিয়াম হায়দ্রাবাদে

অবশ্য জেইন একা নন, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন কর্মচারী রয়েছেন সেখানে। বেশিরভাগই অবশ্য ইংল্যান্ডের নাগরিক। অবশ্য পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকেই মানুষ নিয়োগের জন্য আবেদন জানাতে পারেন। কেউ এই দ্বীপের নির্জনতাকে ভালোবেসে থেকে যান স্থায়ীভাবে। আবার কেউ কিছুদিন কাজ করে চলে আসেন। আর কাজ বলতে বাঁধাধরা কিছুই নেই। সমস্তকিছুই করতে হয় কর্মচারীদের মিলেমিশে। খাবার জল সংগ্রহ থেকে শুরু করে মিউজিয়ামের নানা সামগ্রী পরিষ্কার করা, সবই করতে হয়। সেইসঙ্গে হিংস্র সামুদ্রিক জন্তুদের আতঙ্কও রয়েছে। তাই প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন দিয়ে কর্মচারী নিয়োগের পথে হাঁটে না দক্ষিণ জর্জিয়া প্রশাসন। বরং যে সমস্ত পর্যটকরা সেখানে ঘুরতে যান, তাঁদের আবেদনই গ্রহণ করা হয়। কারণ তাঁরা সেখানকার বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত।

আরও পড়ুন
বিশ্বের প্রথম মোবাইল মিউজিয়াম, দেখা যাবে ফোনের বিবর্তনের ইতিহাস

চারপাশে নীল জলরাশি, মাঝে তুষারে ঢাকা একটি দ্বীপ। তার মধ্যেই একটি মিউজিয়াম। অবশ্য এটিই পৃথিবীর দক্ষিণতম মিউজিয়াম কিনা, তাই নিয়েও বিতর্ক আছে। কারণ আন্টার্কটিকার বুকেই রয়েছে আরেকটি ব্রিটিশ সংগ্রহশালা। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পিটকেইর্ন দ্বীপেও রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। তবে সেইসব সংগ্রহশালায় কেবল গবেষকরা যেতে পারেন। গ্রিটভাইকেনের এই সংগ্রহশালায় পর্যটকদের জন্যও দরজা খোলা। যদিও ২০২০ সালের মার্চ মাসে হঠাৎই মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যায় কোভিডের কারণে। ২০২১ সালে খোলার কথাবার্তা হলেও শেষ পর্যন্ত কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়ে। তবে গত ডিসেম্বরের শেষে আবারও মিউজিয়ামের দরজা খুলে গিয়েছে। আবারও সেখানে গিয়ে পৌঁছেছেন কর্মচারীরা। পর্যটক হিসাবে আপনিও একবার ঘুরে আসতে পারেন সেখানে।

আরও পড়ুন
মিউজিয়ামে আজও সংরক্ষিত রয়েছে গ্যালিলিও-র আঙুল!

Powered by Froala Editor