বিশ্বের ‘সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ফটোগ্রাফ’! সম্মিলিত আইকিউ আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে

১৯৬২ সাল। নোবেল কমিটি পুরস্কারপ্রাপকদের তালিকা ঘোষণার পরেই একটি বিশেষ সমাবেশের আয়োজন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। নোবেলজয়ীদের সংবর্ধনা জানাতেই সেই সভার আয়োজন। সাংবাদিক সম্মেলনে বেশ মজার ছলে সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, হোয়াইট হাউসের সেই সমাবেশই নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ‘স্মার্ট মিটিং’ (Smart Meeting)। হ্যাঁ, সমাবেশে উপস্থিত ব্যক্তিত্বদের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তার নিরিখেই কথাটা বলেছিলেন কেনেডি। কিন্তু আদতে কি তাই? না। বরং, বিজ্ঞানের ইতিহাস তলিয়ে দেখলে ‘স্মার্টেস্ট’-এর আখ্যা দিতে হয় অন্য একটি সমাবেশকে। কোথায় হয়েছিল সেই সমাবেশ? কারাই বা হাজির ছিলেন সেখানে?

সেই প্রশ্নের উত্তরই এই লেখার গন্তব্য। তবে গল্পটা শুরু করা যাক আরও খানিকটা আগে থেকে। বলতে গেলে আধুনিক বিজ্ঞানের দুনিয়ায় বিপ্লব আসে বিশ শতকের শুরু থেকেই। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ব্রেক-থ্রু’। দ্রুত গতিতে উন্মোচিত হতে থাকে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের রহস্য। তবে সমস্যা দেখা যায় অন্য জায়গায়। ততদিনে রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়ে গেছে বিশ্বের। দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। বিশ্বযুদ্ধও আসন্ন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষকদের মধ্যে চিন্তাভাবনা আদান-প্রদানের জায়গাটা যেন আরও সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। 

সমস্যার সমাধানে, অভিনব এক উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সময়ের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান সলভে ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্স অ্যান্ড কেমিস্ট্রি। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের মূল সমস্যাগুলিতে আলোকপাত করতে আয়োজন করে একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন। সলভে সম্মেলন। যার পথ শুরু হয়েছিল ১৯১১ সালে। 

এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করা গেছে বিশ্বের ‘স্মার্টেস্ট মিটিং’-এর সাক্ষী থেকেছিল ব্রাসেলসের এই সম্মেলন? হ্যাঁ, ঠিক তাই। ১৯২৭ সাল। সেটা ছিল সলভে সম্মেলনের পঞ্চম অধিবেশন। আর আলোচনার বিষয় ছিল ‘ইলেকট্রন এবং প্রোটন’। স্বাভাবিকভাবেই সেই সম্মেলনে ডাক পড়েছিল বিশ্বের সেরা প্রতিভাদের। সব মিলিয়ে ২৯ জন বিজ্ঞানী হাজিরা দিয়েছিলেন সেই সমাবেশে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, তার মধ্যে ১৭ জন ব্যক্তিই এই সম্মেলনের আগে বা পরে— কোনো না কোনো সময়ে সম্মানিত হয়েছেন নোবেল পুরস্কারে। তার মধ্যে রয়েছেন মেরি কুরিও। যিনি জীবদ্দশায় দুটি নোবেল পেয়েছেন দুটি পৃথক বৈজ্ঞানিক শাখায়। 

এই সম্মেলনের শেষে সলভে ইনস্টিটিউটের সামনে তোলা হয়েছিল অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানীদের একটি সম্মিলিত চিত্র। যা দেখলে রীতিমতো শিহরিত হতে হয়। কে নেই সেখানে? আইনস্টাইন থেকে শুরু করে নিলস বোর, হাইজেনবার্গ, পল ডিরাক, পাউলি, শ্রডিঞ্জার, মেরি কুরি, হাওয়ার্ড ফাউলার, চার্লস থম্পসন, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক— সকলেই। এ যেন ঠিক চাঁদের হাট। নথি বলছে যাঁদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত আইকিউ ছিল ১৫০-এর ঊর্ধ্বে। ফলে সম্মিলিত আইকিউ নিয়ে আলাদা করে বলার থাকে না কিছুই। পরবর্তীকালে ১৯৯৯ সালে ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন এঁদের মধ্যে থেকেই বেছে নিয়েছিল সর্বকালের সেরা ১০ পদার্থবিদকে। 

আপাতত থাক সেই প্রসঙ্গ। তবে ১৯২৭ সালে সলভে সম্মেলনের সেই ফটোগ্রাফই বিশ্বের ‘সবচেয়ে বুদ্ধিমান ফটোগ্রাফ’। না, কোনো সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল নয়। এহেন স্বীকৃতি দিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা এবং বৈজ্ঞানিক সংগঠনগুলি। ধরে নেওয়া হয়, সমষ্ঠিগত এবং গড় আইকিউ-এর নিরিখে আজও অজেয় সলভে সম্মেলনের এই ছবি। অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই সলভে সম্মেলনের সংশ্লিষ্ট ২৯ জন বিজ্ঞানীর তৈরি করে দেওয়া স্তম্ভের ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একুশ শতকের বিজ্ঞান…

Powered by Froala Editor

More From Author See More