হতাশায় ছাড়তে চেয়েছিলেন খেলাও, ঘুরে দাঁড়িয়েই পদকজয়ী মণিপুরের ‘রুপোর মেয়ে’

ইম্ফল শহর থেকে একটু দূরেই নোংথং কাকচিং গ্রাম। বড় রাস্তার ওপরে একরত্তি চায়ের দোকান।  সেই দোকানে বসেন সাইখম তোমবি দেবী। স্বামী মজুর খাটেন মণিপুর পিডব্লুডি-তে। সামান্যই আয়। দোকান থেকেও যা রোজগার হয়, তাতে চলে না আটজনের সংসার। ছ'টি সন্তানের মা তোমবি। বাকিরা যখন পড়াশোনায় ব্যস্ত, তিনি বেরিয়ে পড়েন তাঁর এক পড়শির জমিতে চাষ করতে। সঙ্গে পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য মীরাবাঈ।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তোমবির দুচোখে জল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, “ওই কচি বয়সেও মীরা চেষ্টা করত, আমার কষ্ট লাঘব করতে। আসলে ছোটো থেকেই সবার খেয়াল রাখা ওর স্বভাব। তাই ক্ষেতে কাজ করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লে মীরা মাথায় তুলে নিত কাঠের বোঝা। আজ সারা ভারতের ভার ওর মাথায়…”

উত্তরপূর্বাঞ্চলের একচিলতে গ্রাম থেকে অলিম্পিক পদকজয়— যাত্রাটা সহজ না মোটেই। কিন্তু ব্যর্থতার কাঁটায় জর্জরিত হতে হতে মীরাবাঈ থামাননি পথচলা। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন একটার পর একটা হারের যন্ত্রণা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে যাননি। মণিপুরের মেয়েরা যে তাঁর মতই অন্য ধাতুতে গড়া।

ওয়েটলিফটিং আর মণিপুর, দুটো শব্দ পাশাপাশি বসালেই মনে পড়ে যাবে কিংবদন্তি কুঞ্জরানি দেবীর কথা। মীরাবাঈ-এর কাছে তিনিই বেঞ্চমার্ক। সম্প্রতি আরো এক মণিপুরী ভারোত্তলক মনিকা দেবীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বিতর্ক। বারবার ডোপিং বিভ্রাটে জড়িয়েছিলেন মনিকা। অনিশ্চয়তা দানা বাঁধছিল মণিপুরী ভারোত্তলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কুৎসা আর সমবেত উৎকন্ঠার মাঝে মীরাবাঈ নিজেকে ঢেলে দিয়েছিলেন অনুশীলনে। গুরু ছিলেন কুঞ্জরানির প্রাক্তন টিমমেট অনিতা চানু। তীরন্দাজ হতে চাওয়া মীরা, অনিতাকে দেখেই প্রেমে পড়েন ওয়েটলিফটিং-এর। শুরু হয় তপস্যা।

সকালে অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং-এর পর মাঝে মাঝে মীরা আর ফিরতেন না গ্রামে। দুপুর বেলা খুদভর্তি সাদাকালো ভাত আর সেদ্ধ সবজি দিয়ে আ্যকাডেমির ঘরেই সেরে নিতেন দুপুরের খাবার। অনিতার নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা। কিন্তু কিছু বলেননি। জানতেন, কখনো সাইকেল, বা ভাগ্যের জোরে ট্রাক পেয়ে গেলেই ঘরে ফিরতে পারে অভাবি মেয়েটি। দিদিদের তাঁত বুনে যেটুকু রোজগার হয়, সেটুকুই তারা ঢেলে দিয়েছে বোনের স্বপ্নের পেছনে… মীরার সঙ্গে লড়ছে তারাও…

সাফল্য এল শীঘ্রই। জুনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মীরার হাত ধরে ২০১৪ কমনওয়েলথ গেমসে রুপো এল ভারতের ঝুলিতে। এরপরে ভেঙে ফেললেন কুঞ্জরানির রেকর্ড। ফলে রিও অলিম্পিকে মীরার ওপর বাজি ধরেছিল দেশ। কিন্তু সেখানেই প্রথম ধাক্কা। ৮২ কেজির স্ন্যাচ বিভাগে মাত্র একটাই ক্লিন লিফট ফিনিশ করতে পেরেছিলেন মীরা। ভারতীয় ওয়েটলিফটিং মহলের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল রাতারাতি।

“রেজাল্টের পর ফোন করেছিল মীরা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।” বলছিলেন তোমবি।

“ভেঙে পড়েছিল খুব। বলেছিল ছেড়ে দেবে ওয়েটলিফটিং। কিন্তু আমি বাধা দিই। বলি, যা একবার শুরু করেছ তা মাঝপথে ছেড়ে দিও না। পালিয়ে যেও না। তোমার সঙ্গে যে লড়ছি আমরাও।”

হয়তো সেদিন তোমবি মেয়ের পাশে না দাঁড়ালে, গত পাঁচবছরে মীরার জীবনটা হয়তো অন্য খাতে বইত। ভারত বঞ্চিত হত কমনওয়েলথ সোনা থেকে। ওয়েটলিফটিং-এ প্রথম অলিম্পিক রৌপ্যপদকও থেকে যেত অধরা।

রুপোয় মোড়া সোনার মেয়ে এবার ফিরবে ঘরে। ‘আমাদের মীরা কখনো খালিহাতে ফেরেনি।” গর্বে গদগদ তোমবি দেবী। মায়ের হাত থেকে কাঠের বোঝা তুলে নেওয়া একরত্তি মেয়ে এনে দিল টোকিও অলিম্পিকের প্রথম মেডেল। 

লড়াইয়ের গল্পগুলো যে একই সুরে বাঁধা...

(ঋণ – ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

Powered by Froala Editor