‘জাতিস্মর’ পূর্ণিমা : দুর্ঘটনা, পরলৌকিক জগৎ ও পুনর্জন্মের এক আশ্চর্য কাহিনি

দেশে তখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। কাজ হারিয়েছে ভাই। অসুস্থ ভগ্নীপতিও। ছ’জনের সংসার সম্পূর্ণভাবে উপার্জনহীন। বাধ্য হয়েই তাই কাজ ছেড়ে পৈতৃক ভিটেয় ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। তিন ভাই-বোন, ভগ্নীপতি আর তাঁর সন্তানের দায়িত্ব তুলে নিয়ে হয়েছিল নিজের কাঁধে। সারারাত জেগে তৈরি করতেন ধূপকাঠি। সেই ধূপকাঠি নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হত দুপুরবেলার ঠা-ঠা রোদ্দুরে। কখনও বিক্রি হত, কখনও আবার ফিরতে হত খালি হাতেই।

সেদিনও ধূপকাঠি বিক্রি করতে বেরিয়েছিলেন তিনি। পথের ধারেই সাইকেলের ওপর সাজিয়ে বসেছিলেন পসরা। তবে আর ফেরা হল না। পিশে দিল উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা একটা বাস। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেও, নিতান্ত ধূপকাঠি বিক্রেতাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি কেউ-ই। তেমনটা হলে হয়তো প্রাণ বাঁচত তাঁর। এই গল্পও হয়তো লেখার প্রয়োজন থাকত না কোনো। 

হ্যাঁ, এই গল্প শুধুমাত্র মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনার গল্প নয়। বরং, জিনদাস পেরেরা (Jinadasa Perera) নামের এই ধূপকাঠি বিক্রেতার গল্প হার মানাতে বাধ্য আচ্ছা আচ্ছা চলচ্চিত্রকেও। কিন্তু কী গল্প? সেই প্রসঙ্গে না হয় পরে আসা যাবে। এই ফাঁকে বলে রাখা যায়, ১৯৮৫ সালে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনার অকুস্থল উত্তর শ্রীলঙ্কার কেলানিয়া প্রদেশের নুগেগোড়া বাজার। 

এবার এগিয়ে যাওয়া যাক আরও তিন-চার বছর। কেলানিয়া থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণের ছোট্ট একটি শহর বাকামুনাতে। এই জনপদ থেকেই শুরু হচ্ছে আমাদের গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের মূল চরিত্রে রয়েছে এক বছর দুয়েকের কিশোরী। পূর্ণিমা একনায়কে (Purnima Ekanayake)। জন্ম ১৯৮৭ সালে। 

মুখে বুলি ফোটার পর থেকেই অদ্ভুত সব কথা বলতে শুরু করে পূর্ণিমা। তখন কতই বা বয়স তার! বড়োজোর দুই কিংবা আড়াই বছর। অথচ, রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি জোরে ছুটে গেলেই, মায়ের আঁচল জড়িয়ে ধরত সে। ভয়ে ভয়ে আধোস্বরে বলে উঠত, ‘ওরা খুব খারাপ লোক। কেউ মারা গেলে ওদের কিচ্ছু যায় আসে না।’ প্রাথমিকভাবে ছোট্ট সন্তানের মুখে এহেন কথা শুনে বেশ অবাকই হতেন তাঁর বাবা-মা। এই বয়সেই এ-ধরনের বোধ তৈরি হওয়া, বেশ আশ্চর্যেরই বটে। তবে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকল পূর্ণিমার বয়ান। জুড়ল, ‘ওরাই আমাকে মেরেছে’। 

ছোট্ট কিশোরীর দাবি ছিল এমনটাই। গতজন্মে তাকে নাকি পিশে গিয়েছিল এমনই একটি ছুটন্ত গাড়ি। বুকেও ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল গাড়ির চাকা। আর সেই দাগ রয়ে গেছে আজও। হ্যাঁ, এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, বুকে আড়াআড়ি গভীর কালো দাগ নিয়েই জন্মেছিল পূর্ণিমা। কিন্তু বছর দুয়েকের কিশোরীর মনে হঠাৎ তার এই ব্যাখ্যা আসে কীভাবে? ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখেননি তার বাবা-মা। শিক্ষক দম্পতি হওয়ায়, এমন অবৈজ্ঞানিক গল্প শোনানোর জন্য বেশ বকাঝকাও করেছিলেন তাঁরা। তবে তাতে লাভ হয়নি কোনো। 

তবে পূর্ণিমার এইসব প্রলাপ আদৌ সত্যি কিনা, প্রথমবার তা পরীক্ষা করে দেখার  সুযোগ আসে ১৯৯৩ সালে। সপরিবারে সেবার কেলানিয়া মন্দিরে ঘুরতে গিয়েছিলেন পূর্ণিমার বাবা। এই মন্দিরে পা দিয়েই হঠাৎ করে বদলে যায় পূর্ণিমার আচার-আচরণ। যেন এই মন্দির, আশেপাশের অলিগলি- সবই যেন তার চেনা। তবে আশ্চর্য হওয়ার তখনও বাকি ছিল বৈকি। এর পর পূর্ণিমা বায়না জুড়ে বসে, বাড়ি যাবে সে। বাধ্য হয়েই সেদিন তাকে নিয়ে নিকটবর্তী এক ধূপবিক্রেতার বাড়িতে হাজির হতে হয়েছিল তার বাবা-মাকে। যাঁর নাম ‘জিনেদাস পেরেরা’। 

হ্যাঁ, ১৯৮৫-তে বাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো সেই জিনেদাসের কথাই হচ্ছে। পূর্ণিমার দাবি ছিল সে-ই জিনেদাস। এমনকি জিনেদাসের পৈতৃক ভিটেয় গিয়ে তাঁর সমস্ত আত্মীয়-পরিজনদেরও চিনতে পেরেছিল সে। স্মৃতি খুঁড়ে তুলে এনেছিল তাঁদের শৈশবের ডাকনামও। কীভাবে ধূপ বানাতে হয়, কী কী উপাদান মেশাতে হয় কোন অনুপাতে- তা-ও গড় গড় করে বলে দিয়েছিল ছোট্ট পূর্ণিমা। এমনকি কেন ধূপের প্যাকেটের রং ও নকশা কেন বদলে ফেলা হয়েছে, তা নিয়েও পূর্ণিমা অভিযোগ জানায় প্রয়াত জিনদাসের ভগ্নীপতি উইজিসিরির কাছে। 

মজার বিষয় হল, ‘আমাবিগা’ ও ‘গীতা পিচ্ছা’ নামের যে দুটি ব্র্যান্ডের ধূপকাঠি তৈরি করতেন জিনদাস, সেই দুটোই মূলত রপ্তনি করা হত দক্ষিণ শ্রীলঙ্কায়। পাওয়া যেত না স্থানীয় বাজারে। কেবলমাত্র পৈতৃক ভিটেয় ফেরার পরই মাত্র কয়েকদিনের জন্য কেলানিয়ার রাস্তায় রাস্তায় এই ধূপ বিক্রি করেছিলেন জিনদাস। 

এই গল্প আদতে জাতিস্মরবাদের, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা থাকে না। ‘সোনার কেল্লা’-র মুকুল কিংবা দিল্লির লুগড়ি থুড়ি শান্তি দেবীর কথা তো সকলেরই জানা। কথিত আছে গৌতম বুদ্ধও বলতে পারতেন তাঁর গতজন্মের কথা। যা পরিচিত ‘জাতকের গল্প’ নামে। তবে এ-সবের থেকে পূর্ণিমার এই গল্পকে আলাদা করে তোলে তাঁর পরলৌকিক জগতের অভিজ্ঞতা। 

হ্যাঁ, মৃত্যু-পরবর্তী জগৎ কেমন, তার এক আশ্চর্য বর্ণনা দিয়েছিল পূর্ণিমা। জানিয়েছিল, দুর্ঘটনার পরই অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল তার দুচোখে। তারপর চোখ খুলতেই দেখতে পেয়েছিলেন নিজের মৃতদেহ, পরিবার-পরিজনের কান্না, মানুষের ভিড়। এমনকি সে নাকি এও জানতে পেরেছিল, ভেঙেছে তার পাঁজরের চারটি হাড়। ফেটেছে ফুসফুস, যকৃৎ। পরবর্তীতে নাকি হাওয়ায় ভেসে বেড়াত সে। তবে একা নয়, এই আশ্চর্য দুনিয়ায় তার সঙ্গী ছিল আরও বহু মানুষ। শেষে এক আলোকরশ্মিকে অনুসরণ করতে গিয়েই নাকি আবার ঝাপসা হয়ে যায় চোখ। তারপরই ফিরে আসা পূর্ণিমার রূপে। 

১৯৮৮ থেকে ১৯৯৯- দীর্ঘ ১১ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় জাতিস্মরবাদ নিয়ে গবেষণা চালান স্কটিশ গবেষক ও মনোবিদ আর্লেন্দার হ্যারাল্ডসন। মোট ৬৪ জনের ওপর এই সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি। সংগ্রহ করেছিলেন আশ্চর্য সব গল্প এবং জাতিস্মরবাদের প্রমাণ। তা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর দুটি বই- ‘ইন সার্চ অফ ডেড’ এবং ‘পাস্ট লাইভস - স্টোরিস অফ রিইনকার্নেশনস’। এই দুটি গ্রন্থেই জায়গা পেয়েছিল পূর্ণিমার গল্প। এমনকি পূর্ণিমাই ছিল একমাত্র জাতিস্মর যে কিনা শুনিয়েছিল পরলৌকিক জগতের গল্প।  যে দুনিয়াকে হ্যারাল্ডসন অভিহিত করেছিলেন 'সোল রেল্ম‌' (Soul Realm) নামে। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, পূর্বজন্মে পুরুষ হলেও মৃত্যুর পর কিশোরী হয়ে জন্ম নিয়েছিল সে। যা জাতিস্মরবাদের দুনিয়ায় বিরলতম ঘটনা।

সময় গড়িয়েছে। পেরিয়ে গেছে কয়েক দশক। এর মধ্যে বার বার ফিরে ফিরে এসেছে পূর্ণিমার গল্প। সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে ‘নতুন’ জাতিস্মররাও। তবে পূর্বজন্ম-পরজন্ম বলে আদৌ কিছু হয় নাকি, বিতর্ক রয়েই গেছে। প্রমাণ হিসাবে কিছু ঘটনাবলি উপস্থাপন করা হলেও, জাতিস্মরবাদ নিয়ে বিজ্ঞান কোনো যুক্তি দিতে পারেনি আজও…

তথ্যসূত্রঃ
১. Purnima Ekanayake (reincarnation case), psi-encyclopedia.spr.ac.uk
২. A Man Reincarnates as a Girl Who Loves Beautiful Dresses: The Reincarnation case of Jinadasa Perera| Purnima Ekanayake,  Walter Semkiw, reincarnationresearch.com

Powered by Froala Editor

More From Author See More