এক সময় ছিল হিরের খনি, আজ মরুভূমিতে পরিত্যক্ত ‘ভূতুড়ে শহর’

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের সেই অংশটা মনে আছে? আফ্রিকার গভীর অরণ্যে পর্তুগিজ অভিযাত্রী ডিয়েগো আলভারেজকে মৃত্যুমুখ থেকে উদ্ধার করে এনেছে শঙ্কর। আলভারেজ বলছে তাঁর অতীতের গল্প। এক প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠীর কাছে হিরের সন্ধান পেয়ে শুরু করে অভিযান। বুনিপের হাতে মারা যায় তাঁর সঙ্গী। প্রতিবার বিফল হয়েছে সন্ধান। সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে।

উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার তিন দশক আগে, ১৯০৮ সালে আফ্রিকার নামিবিয়ার মরুভূমিতে ঘটে এরকমই এক ঘটনা। আজকে সেই জায়গার নাম ‘কোলম্যানস্কোপ’ (Kolmanskop)। অঞ্চলটি তখন জার্মানির উপনিবেশ। জোরকদমে চলছে রেললাইন বিস্তারের কাজ। জাকারিয়াস লেওয়ালা নামের এক নামিবিয়ার কর্মী আচমকাই আবিষ্কার করে একটি হীরকখণ্ড। সঙ্গে সঙ্গে দেখায় জার্মান রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তাকে। হিরে চিনতে ভুল হয়নি তাঁরও। তল্লাশি শুরু হয় গোটা মরুঅঞ্চলে। পাওয়া যায় হিরের খনির সন্ধান। 

মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটিতে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয় জার্মান সরকার। শুরু হয় খননের কাজ। হিরের নেশায় জড়ো হতে থাকে অসংখ্য মানুষ। ক্রমে মরুভূমির মধ্যে গড়ে ওঠে একটা খাঁটি জার্মান শহর। বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল, কারখানা, সিনেমাহলে পরিপূর্ণ শহরটি দেখে কে বলবে কদিন আগেও এই অঞ্চলের নাম জানত না লোকে? চালু হয় ট্রামব্যবস্থা। নামিবিয়ার লুডেরিজ শহরের সঙ্গে তৈরি হয় রেল যোগাযোগ।

কিন্তু সৌভাগ্য স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। ১৯১৪-র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ফুরিয়ে আসতে থাকে হিরের ভাণ্ডার। ১৯২০-র মধ্যে হারিয়ে যায় শহরটির কৌলিন্য। এরই মধ্যে ১৯২৮ সালে কোলম্যানস্কোপের দক্ষিণে অরেঞ্জ নদীর ধারে আবিষ্কৃত হয় আরেকটি হিরের খনি। আকারে এর চেয়ে বড়ো, হিরের পরিমাণও অনেক বেশি। মৃতপ্রায় শহরে এমনিই প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল মানুষের, হিরের নেশায় আবার চকচক করে উঠল চোখ। পড়ে রইল বাড়িঘর। বাকি সম্বলটুকু নিয়ে দল বেঁধে রওনা দেয় নতুন খনির উদ্দেশ্যে। জনশূন্য হয়ে পড়ে কোলম্যানস্কোপ।

আরও পড়ুন
স্বমহিমায় চলছে দাসপ্রথা, এখনও মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ডুবে আফ্রিকার এই দেশ

যেমন কাহিনির মতো আকর্ষণীয় উত্থান শহরটির, তেমনই অদ্ভুত এর নামের ইতিহাসও। জার্মান শব্দ ‘কোলম্যানস্কোপ’-এর অর্থ ‘কোলম্যানের মাথা’। হিরের খনি আবিষ্কারের আগে জার্মান জন কোলম্যান গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন এর উপর দিয়ে। আচমকা মরুঝড়ে পথ হারিয়ে গাড়িটিকে ফেলেই পালান তিনি। সেই থেকে শুরু। তারপর হিরের জৌলুসে সাময়িক কৌলিন্য। অবশেষে ১৯৫৬-তে সম্পূর্ণরূপে ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করা হয় শহরটিকে। বাড়িগুলি রয়ে গেছে আগের মতোই, তবে এক হাঁটু বালিতে ডুবে গেছে প্রতিটা ঘর। মরুঝড় হানা দেয় প্রায়শই। জনহীন প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে থাকে নির্জন ‘ভূতুড়ে শহর’ (Ghost Town)। 

আরও পড়ুন
এ যেন সত্যিই ‘চাঁদের পাহাড়’, হিরের সন্ধানে ছুটছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অজস্র মানুষ

আজও এখানে ঢুকতে গেলে নামিবিয়া সরকারের অনুমতিপত্র প্রয়োজন। তবে কিছু হলিউডি ছবির চিত্রগ্রহণ হয়েছে এখানে। নিয়মিত আনাগোনা করছেন ফটোগ্রাফাররাও। ক্রমশ পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে শহরটি। ফলে একেবারে পরিত্যক্ত হওয়ার কলঙ্ক তার ঘুচেছে।

Powered by Froala Editor